ইউক্রেনে আটকেপড়া চট্টগ্রামের রোহান বলছেন— বেঁচে থাকাটাই এখন চ্যালেঞ্জ

ইউক্রেন থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি দেশে ফেরার কথা ছিল চট্টগ্রামের সন্তান রোহান চৌধুরীর। কিন্তু রাশিয়ার আক্রমণের পরই তিনি আটকা পড়ে গেছেন ইউক্রেনের দ্বিতীয় প্রধান শহর খারকিভে।

চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর শাকপুরায় রোহান চৌধুরীর বাড়ি। ইউক্রেনের খারকিভ ইনস্টিটিউট অফ মেডিসিন এন্ড বায়োমেডিকেল সায়েন্সে ডাক্তারি পড়ছেন। সেখানে এখন তিনি পঞ্চম বর্ষের প্রথম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী।

চট্টগ্রামে বোনের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। সেই উপলক্ষে রোহানেরও ইউক্রেন থেকে চট্টগ্রামে আসার কথা। তার ওমানপ্রবাসী বাবা-মা ইতিমধ্যে চট্টগ্রামে চলে এসেছেন। কিন্তু রোহান এখনও জানেন না, যুদ্ধপীড়িত ইউক্রেন থেকে তিনি কিভাবে চট্টগ্রামে ফিরবেন।

রোহান বলেন, ‘তিন বছর বয়সে মা-বাবার হাত ধরে দেশ ছেড়েছিলাম। মা-বাবা ওমানে থাকতেন। সেখান থেকে ২০১৮ সালে ইউক্রেনে এলাম। খারকিভ শহরে থাকি। খারকিভ ইনস্টিটিউট অব মেডিসিন অ্যান্ড বায়োমেডিক্যাল সায়েন্সে পড়ছি। পঞ্চম বর্ষের ছাত্র আমি। প্রতিষ্ঠানটিতে বাংলাদেশি খুব একটা নেই। তবে পাশে আরো বেশ কিছু বড় বড় প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে খারকিভ ন্যাশনাল পেডাগজিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, খারকিভ স্টেট একাডেমি অব ফিজিক্যাল কালচার—এসব জায়গায় অনেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী আছে। কয়েক মাস ধরে পত্রিকা ও টিভি দেখে বুঝতে পারছিলাম রাশিয়ানরা ইউক্রেনে কিছু একটা করতে পারে। কিন্তু ইউক্রেনের মতো শান্তিপ্রিয় জায়গায় যুদ্ধ লাগতে পারে, এটা ভাবিনি।’

তিনি বলেন, ‘২৩ তারিখ রাতে ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ চারদিকে মানুষের চিৎকার, হুড়াহুড়ি। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলাম রাশিয়ান সেনাবাহিনী ইউক্রেনে আক্রমণ করেছে। তবু বিশ্বাস হচ্ছিল না। তবে সত্যিই সত্যিই পরদিন সকাল থেকে খারকিভে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। খারকিভ রাশিয়ার সবচেয়ে কাছে, এমনকি কিয়েভের চেয়েও। তাই আক্রমণের প্রথম ধাক্কাটা আমাদের ওপরই আসে। যে বাসায় থাকি, সেখানে আমার সঙ্গে থাকে ভারতীয় কয়েকজন ছাত্র। তখনো আমরা ভাবছিলাম হয়তো কিয়েভে হালকা গোলাগুলি হবে। এরপর স্বাভাবিক হয়ে আসবে সব কিছু।’

রোহান বলেন, ‘তবে রাতের আগেই এই ভুল ভেঙে যায়। চারদিক থেকে বিমানের শব্দে কান ভারী হতে থাকে। বুঝতে পারি অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। বন্ধুরা মিলে ঠিক করি কয়েক দিনের খাবার মজুদ করে রাখব। এখানকার কোনো সুপারশপে চাল, ডাল, ময়দা নেই। এসব আমাদের যাওয়ার আগেই শেষ হয়ে গেছে। আছে শুধু ফল-সবজি। যা পেয়েছি তা নিয়েই বাসায় চলে এসেছি। এখানে মোটামুটি আকারের একটি রুটির দাম কয়েক দিন আগেও ছিল ইউক্রেনীয় মুদ্রায় ৩০ থেকে ৪০ হ্রিভনিয়া। এখন সেটা ১৫০ থেকে ২০০-তে ঠেকেছে। তবে কেউ দামের দিকে তাকাচ্ছে না। সবচেয়ে বেশি লাইন ফার্মেসিগুলোর সামনে। ২৪ তারিখের পর থেকে খারকিভে রাতে কারফিউ চলছে। তাই দিনেই যতটুকু সম্ভব বাইরে থেকে কেনাকাটা করা যায়। তবু পা বাড়াতে হয় ভয়ে ভয়ে। কেউ বাইরে গেলে ফিরে আসবে কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।’

তিনি বলেন, ‘২৫ তারিখের পর থেকে খারকিভের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেছে। রাস্তায় ভালোভাবে হাঁটার অবস্থাও নেই। প্রতিটি আবাসিক এলাকায় খাবার পানির লাইন বন্ধ। শহরে থাকা গ্যাস পাইপলাইন লক্ষ্য করেও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে রাশিয়া। পাইপলাইনটি খারকিভ শহরবাসীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একদিকে খাবার পানি নেই, আবার গ্যাস ও বিদ্যুৎ চলে গেলে জীবন চালানো কঠিন হয়ে যাবে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর শহরের বেশির ভাগ মানুষ বাংকারে আশ্রয় নিয়েছে। ফলে আমরাও পুশকিনস্ক মেট্রো স্টেশনে গিয়েছিলাম। কিন্তু টয়লেট ও খাবার সমস্যা সেখানে এত বেশি যে মৃত্যুর আগেই ‘মরে’ যেতে হচ্ছিল। এক দিন পরেই আবার নিজেদের বাসায় চলে আসি।’

রোহান বলেন, ‘ইউক্রেনে এত বাংলাদেশি, অথচ এখানে বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস নেই। বাংলাদেশ থেকে বলছে, পোল্যান্ড চলে যেতে। খারকিভ ইউক্রেনের একেবারে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর। এখান থেকে পোল্যান্ডের নিকটবর্তী সীমান্তও প্রায় এক হাজার কিলোমিটারের থেকেও বেশি দূরে। রাস্তায় বের হওয়াটাই যেখানে ঝুঁকির, সেখানে এত দূর পথ পাড়ি দেওয়াটাও অসম্ভব। আবার কারফিউ চলার সময় রাস্তায় বের হলে ইউক্রেনীয় সৈন্যরা আমাদের রাশিয়ান গুপ্তচর ভেবে আটক করতে পারে। আমাদের সবচেয়ে কাছের বিমানবন্দর বেলগর্ড আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। রাশিয়ার এই বিমানবন্দর খারকিভ থেকে মাত্র ৯০-৯৫ কিলোমিটার দূরে।’

বাংলাদেশে ফিরে আসার আকুতি জানিয়ে রোহান চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার কূটনৈতিকভাবে রাশিয়ার এই বিমানবন্দর আমাদের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে পারলে এখানে থাকা বাংলাদেশিরা সবাই প্রাণে বেঁচে যাবে। আমার সঙ্গে থাকা ভারতীয়রা সবাই তামিলনাড়ুর অধিবাসী। তাদেরকে তাদের মুখ্যমন্ত্রী আশ্বস্ত করেছেন, রাশিয়ার সঙ্গে কথা বলে তাদের দেশে নিয়ে যাবেন। ভারতীয় ছাত্ররা রাশিয়ার বিমানবন্দর ব্যবহার করে দেশে যেতে পারলে আমাদের ব্যবহারের পথটাও উন্মুক্ত হতে পারে। তবে সরকারকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে।’

চট্টগ্রামে মন পড়ে থাকা রোহান বলেন, ‘বোনটার বিয়ে ঠিক হয়েছে। গত ২৬ তারিখ বাংলাদেশে যাওয়ার কথা ছিল আমার। তবে আটকা পড়ে গেছি যুদ্ধের মাঠে। দুই বছর করোনার কারণে পরিবারের কারোর সঙ্গে দেখা হয়নি। এবার যখন দেখা হবে ভাবলাম, তখন যুদ্ধ সব গোলমেলে করে দিয়েছে। আজ (২৮ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকেই শুধু বোমা আর গোলাগুলির শব্দ পাচ্ছি। এখন বেঁচে থাকাটাই চ্যালেঞ্জ। বেঁচে থাকলে আবার বাংলাদেশে যাব। ধুমধাম করে বোনের বিয়ে দেব।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!