ইংল্যান্ডের দুর্দশা আর বাংলাদেশের আশা বাড়িয়ে সেমিতে অস্ট্রেলিয়া

ইংল্যান্ডের দুর্দশা আর বাংলাদেশের আশা যেন সমানতালে চলছে। আগের ম্যাচে ইংল্যান্ড ১৯৯৬ আসরের চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কার কাছে অঘটনের শিকার হওয়ার পর বর্তমান চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও হারলো ইংল্যান্ড। মঙ্গলবার লর্ডসে বিশ্বকাপের ‘হট ফেভারিট’ দলকে ৬৪ রানে হারিয়ে শীর্ষে উঠে গেছে অজিরা। আর টানা দুই হারে সেমিফাইনালে ওঠা নিয়ে শঙ্কায় স্বাগতিকরা।

৭ ম্যাচে ১২ পয়েন্ট নিয়ে নিউজিল্যান্ডকে টপকে গেছে অস্ট্রেলিয়া। এক ম্যাচ কম খেলে ১১ পয়েন্টে দ্বিতীয় স্থানে কিউইরা। হেরে গেলেও সেরা চারেই আছে ইংল্যান্ড, ৭ ম্যাচে ৮ পয়েন্ট নিয়ে চতুর্থ তারা। বাংলাদেশ (৭) সমান খেলে মাত্র এক পয়েন্ট পেছনে থেকে তাদের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে।

চার বছর আগে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া তাদের বিশ্বকাপ শুরু করে মুখোমুখি লড়াইয়ে। মেলবোর্নে ওই ম্যাচে অ্যারন ফিঞ্চের ১৩৫ রানের কল্যাণে ১১১ রানে ইংলিশদের হারায় অজিরা। এবার তিনি অধিনায়ক, খেললেন আরেকটি সেঞ্চুরির ইনিংস। তাতে দুই বিশ্বকাপেই ইংল্যান্ড বধে ম্যাচসেরা হলেন এই ওপেনার।

ফিঞ্চের ১০০ রানের ইনিংস সেরা পারফরম্যান্সে ৭ উইকেটে ২৮৫ রান করে অস্ট্রেলিয়া। জবাবে জেসন বেহরেনডর্ফের ক্যারিয়ারসেরা বোলিংয়ে ৪৪.৪ ওভারে ২২১ রানে অলআউট হয় ইংল্যান্ড।

ইংল্যান্ডের দুর্দশা আর বাংলাদেশের আশা বাড়িয়ে সেমিতে অস্ট্রেলিয়া 1
এই বিশ্বকাপে এটি ফিঞ্চের দ্বিতীয় শতক।

আর মঙ্গলবার টাইগারদের আশা বাড়িয়ে দেয়া অস্ট্রেলিয়ার এ জয়টি এসেছে মূলত বাঁহাতি পেসার জেসন বেহরেনডর্ফের হাত ধরে। ক্যারিয়ার সেরা বোলিংয়ে ৫ উইকেট নিয়ে তিনি একাই ধ্বসিয়ে দিয়েছে ইংলিশ ব্যাটিং লাইনআপ। আগুন ঝরিয়েছেন মিচেল স্টার্কও। তিনি ৪ উইকেট শিকার করে বিশ্বকাপের এবারের আসরে নিজের উইকেট শিকারের সংখ্যা নিয়ে গেছেন ১৯-এ।

লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শুরু থেকেই পথ হারানো ইংল্যান্ডকে বলতে গেলে একাই টানছিলেন বেন স্টোকস। কেন ইংলিশরা তাঁকে অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফের যোগ্য উত্তরসূরি মনে করেন, সেটির প্রমাণ আরও একবার দিচ্ছিলেন। একের পর এক সাহসী শটে যেন মনে করিয়ে দিতে চাইছিলেন, তিনি উইকেটে থাকা পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার জয় নিশ্চিত নয়। পথের শেষ কাঁটা সরাতে অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক শরণাপন্ন হলেন নিজের সেরা অস্ত্র স্টার্কের। আস্থার প্রতিদান এর চেয়ে ভালোভাবে বোধ হয় দিতে পারতেন না বাঁহাতি ফাস্ট বোলার।

স্টোকস যেভাবে এগোচ্ছিলেন, তাঁকে ফেরানোর জন্য বিশেষ একটি বলেরই দরকার ছিল। ঠিক সেটিই করলেন স্টার্ক। দুরন্ত গতিতে ছুটে এসে যে নিখুঁত ইয়র্কারে স্টাম্প উপড়ে ফেললেন, ৮৯ রানে দাঁড়িয়ে থাকা স্টোকসের বিন্দুমাত্র সাধ্য ছিল না সেটি ঠেকানোর। ওই এক বলেই নিশ্চিত হয়ে গেল, বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২৭ বছরের জয়-খরা এবারও ঘোচানো হচ্ছে না ইংলিশদের। শেষ পর্যন্ত হয়েছেও তাই। অস্ট্রেলিয়ার ২৮৫ রানের জবাবে ২২১ রানেই থেমেছে ইংল্যান্ড। ২০১৭ সালের জানুয়ারির পর প্রথমবারের মতো টানা দুই ওয়ানডে হেরে সেমিফাইনালের স্বপ্নটাকেও আরেকটু ধূসর বানিয়ে ফেলল ইংলিশরা।

ইংল্যান্ডের দুর্দশা আর বাংলাদেশের আশা বাড়িয়ে সেমিতে অস্ট্রেলিয়া 2
ইংল্যান্ডের ব্যাটিংয়ে দুর্দশার প্রধান কারিগর জেসন বেরেনডর্ফ। বিশ্বকাপে নিজের দ্বিতীয় ম্যাচেই পাঁচ উইকেট শিকার করেন তিনি।

ইংল্যান্ড মূলত হেরে গেল অস্ট্রেলিয়ার দুই বাঁহাতি পেসার মিচেল স্টার্ক ও জেসন বেরেনডর্ফের কাছেই। দুজনে মিলে ভাগ করে নিয়েছেন ৯ উইকেট। স্টোকসকে এমন নিঃসঙ্গ যোদ্ধা বানানোর দায় ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের যতটা, তার চেয়ে বেশি কৃতিত্ব অস্ট্রেলীয় পেসারদের। ইনিংসের দ্বিতীয় বলেই ভয়ংকর এই ইনসুইংয়ে জেমস ভিন্সের মিডল স্টাম্প উড়িয়েছেন বেরেনডর্ফ। এটি দিয়ে শুরু, এরপর আরও চারটি উইকেট তুলেছেন এ বাঁহাতি পেসার। ৪৪ রানের বিনিময়ে ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো ৫ উইকেট তুলে নিয়েছেন বেরেনডর্ফ।

উইকেট সংখ্যায় বেরেনডর্ফের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও লর্ডসের ‘লর্ডস’ হওয়ার ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার মূল নায়ক ছিলেন স্টার্ক। স্টোকসকে আউট করার আগে আরও বড় সর্বনাশ করেছেন ইংল্যান্ডের। চতুর্থ ওভারেই ইংলিশ ব্যাটিং লাইন-আপের সবচেয়ে বড় স্তম্ভ জো রুটকে এলবিডব্লুর ফাঁদে ফেলেছেন দারুণ এক ইনসুইঙ্গারে। নিজের পরের ওভারেই ফিরিয়েছেন আফগানিস্তানের বিপক্ষে এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ছয় হাঁকানোর বিশ্ব রেকর্ড করা অধিনায়ক এউইন মরগানকেও। বলতে গেলে ইংলিশ ব্যাটিংয়ের মেরুদণ্ডটাই ভেঙে দিয়েছেন। আদিল রশিদকে ফিরিয়ে ম্যাচটা শেষও করেছেন স্টার্কই। ৪৩ রান দিয়ে ৪ উইকেট পাওয়া স্টার্কের এ বিশ্বকাপে উইকেট হয়ে গেল ১৯টি। মোহাম্মদ আমির ও জফরা আর্চারকে পেছনে ফেলে বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারিও এখন তিনি।

হুমকি হতে পারতেন জনি বেয়ারস্টো বা জস বাটলাররাও। বেয়ারস্টোকে (২৭) ফিরিয়েছেন বেরেনডর্ফ, আর বাটলার (২৫) ফিরেছেন মার্কাস স্টয়নিসের বলে বাউন্ডারিতে উসমান খাজার দারুণ ক্যাচ হয়ে। পুরো ম্যাচেই অস্ট্রেলিয়ার ফিল্ডিং ছিল চোখে লেগে থাকার মতো। অ্যারন ফিঞ্চের অধিনায়কত্বও ছিল দুর্দান্ত।

চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের বিপক্ষে এই জয়ে এবারের বিশ্বকাপের প্রথম দল হিসেবে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে ফেলল বর্তমান চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া। আর সেমিফাইনালে ওঠাকে আরেকটু সংশয়ের মুখে ফেলে দিল বড় মঞ্চে ‘চোক’ করতে অভ্যস্ত ইংল্যান্ড।

এর আগে টস হেরে ব্যাট করতে নেমে ওপেনিং জুটিতেই অসিরা তুলেছে ১০০ প্লাস রান। ১২৩ রানের মাথায় ওয়ার্নার আউট হন হাফ সেঞ্চুরি করে। মাঝে উসমান খাজা মাত্র ২৩ রান করে আউট হয়ে গেলেও অপর ওপেনার অ্যারোন ফিঞ্চ সেঞ্চুরি করেই সাজঘরে ফেরেন। ১১৫ বলে সেঞ্চুরি করেন অসি অধিনায়ক। ১১টি বাউন্ডারির সঙ্গে ২টি ছক্কার মার মারেন তিনি। সেঞ্চুরি করার পরের বলেই জোফরা আর্চারের বলে ক্রিস ওকসের হাতে ক্যাচ দেন ফিঞ্চ।

ইংল্যান্ডের দুর্দশা আর বাংলাদেশের আশা বাড়িয়ে সেমিতে অস্ট্রেলিয়া 3
টানা দ্বিতীয় ম্যাচে দারুণ খেলা স্টোক সামলাতে পারেননি মিচেল স্টার্ক এর হাত থেকে বের হওয়া নিঁখুত ইয়র্কারটি।

তবে ফিঞ্চ আউট হলেও অস্ট্রেলিয়ার রান বাড়ছিল হু-হু করে। মাত্র ৩৭ ওভারেই ২০০ রান পূর্ণ করে ফেলে তারা। ফিঞ্চ আউট হওয়ার পর মাঠে নেমে ঝড় তোলেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। কিন্তু বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। মাত্র ৮ বলে ১২ রান করে মার্ক উডের বলে বাটলারের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান তিনি। শুরুতে ইংলিশ বোলারদের কোনো পাত্তাই দিচ্ছিল না দুই অসি ওপেনার। ক্রিস ওকস, জোফরা আর্চার, মার্ক উড, বেন স্টোকস- এই চার পেসারের সঙ্গে আদিল রশিদ এবং মঈন আলি- এই দুই স্পিনারেও কোনো কাজ হচ্ছে না। উইকেটের দেখা মিলছিল না।

শেষ পর্যন্ত সফল হন মঈন আলি। ২৩তম ওভারের চতুর্থ বলে গিয়ে পেলেন উইকেটের দেখা। মঈন আলিকে খেলতে গিয়ে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ক্যাচ তুলে দেন ডেভিড ওয়ার্নার। জো রুট সেই ক্যাচটি আর মিস করলেন না। ৬১ বলে ৫৩ রান করে ফিরে গেলেন ওয়ার্নার। ৬টি বাউন্ডারিতে নিজের ইনিংস সাজান তিনি। ২৩ রান করা উসমান খাজাকে বোল্ড করেন বেন স্টোকস। গ্লেন ম্যাক্সওয়েল মার্ক উপের বলটি চেয়েছিলেন উইকেরক্ষকের মাথার ওপর দিয়ে তুলে দেবেন। কিন্তু পারলেন না। বরং, ব্যাট চুমু দিয়ে বল গিয়ে পড়ে উইকেটরক্ষক বাটলারের গ্লাভসে। ১২ রান করে আউট হন তিনি।

স্টিভেন স্মিথ ক্রিস ওকসের বলে ক্যাচ দেন আর্চারের হাতে। তার আগে তিনি করেন ৩৪ বলে ৩৮ রান। শেষ দিকে অ্যালেক্স ক্যারে কিছুটা মারমুখি হন। ২৭ বল থেকে তিনি করেন ৩৮ রান। শেষ পর্যন্ত ৭ উইকেট হারিয়ে ২৮৫ রান সংগ্রহ করে অস্ট্রেলিয়া। ক্রিস ওকস ২টি, আরচার, মার্ক উড, বেন স্টোকস, মঈন আলি এবং আদিল রশিদ নেন ১টি করে উইকেট।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!