আমদানির আড়ালে টাকা পাচারের জমজমাট রুট চট্টগ্রাম

ঠেকানোর উদ্যোগ নেই চট্টগ্রাম কাস্টমসে

মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানির বিপরীতে প্রতি বছর কোটি টাকা পাচার হচ্ছে বিদেশে। চট্টগ্রাম কাস্টমসে আমদানি বাণিজ্যের ঋণপত্রের (এলসি) মাধ্যমে মানিলন্ডারিং (অর্থপাচার) হচ্ছে। সম্প্রতি মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি চালান জব্দ করেছে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে একটি সিন্ডিকেট সক্রিয় এ মানিলন্ডারিংয়ে। সিএন্ডএফ এজেন্ট, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ও কাস্টমসের কতিপয় কর্মকর্তা এ সিন্ডিকেটে জড়িত। সংশ্লিষ্টরা জানান, ওভার ইনভয়েসিং এবং মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে অর্থ পাচার চললেও কোন ঘটনারই কূলকিনারা করা সম্ভব হয়নি। মামলা হয়েছে শুধুই নামেমাত্র।

এদিকে পাচার ঠেকাতে গত বছর চট্টগ্রাম কাস্টমসে অ্যান্টি মানিলন্ডারিং শাখা গঠন করা হলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। শাখাটি দৃশ্যত কোন কাজই করতে পারেনি।

আমদানি বাণিজ্যের আড়ালে টাকা পাচার ঠেকাতে গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের ডেপুটি কমিশনার নুর উদ্দিন মিলনকে প্রধান করে ৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটির মাধ্যমে অ্যান্টি মানিলন্ডারিং শাখা গঠন করা হয়। কিন্তু আলাদাভাবে কোন শাখা না করায় এ কমিটির কাজের তেমন অগ্রগতি নেই।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমসের অ্যান্টি মানিলন্ডারিংয়ের দায়িত্বে থাকা উপ কমিশনার নুর উদ্দিন মিলন বলেন, ‘মানিলন্ডারিং ঠেকাতে কাস্টমসের আলাদাভাবে শাখা চালু করতে হবে। শুধু তারাই এটি নিয়ে কাজ করবে। কিন্তু আমাদের বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে মানিলন্ডারিংয়ের দায়িত্ব পালন করতে হওয়ায় অনেক সময় সঠিকভাবে কাজ করা সম্ভব হয় না।’

তিনি বলেন, বিগত কয়েক মাস আগে মানিলন্ডারিং বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছি একটি আমদানিকারক কোম্পানি মানিলন্ডারিং খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। মানিলন্ডারিং ঘটনার ব্যাপারে কোন আমদানিকারকের বিরুদ্ধে মামলা করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অনুমোদন নিতে হয়।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে নানাভাবে ওভার ইনভয়েসিং করে যেমন ডলার পার করে দেওয়া হয়েছে, তেমনি মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে খালি কন্টেইনার এনেও প্রায় কোটি ডলার পাচার করা হয়েছে।

বিভিন্ন ব্যাংকের কয়েক হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান মাধ্যম আমদানি বাণিজ্য। কোটি ডলারের পণ্য আমদানির আড়ালে বিপুল অর্থ পাচার করা হয়েছে। বিদেশি রপ্তানিকারকদের অ্যাকাউন্ট থেকে পাচারকৃত অর্থ সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকদের বিদেশি অ্যাকাউন্টে চলে গেছে। দুবাই, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, চীনসহ নানা দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এসব অর্থপাচারের কোন কূলকিনারা হয়নি।

কাস্টম হাউসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. আতিক জানান, ‘চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানাধীন ৮২৯ জুবিলি রোডের আনজুমান শপিং কমপ্লেক্সের মেসার্স সৈয়দ ট্রেডাসের আমদানি করা পণ্যের চালানটি খালাসের দায়িত্বে ছিল আগ্রাবাদ বাদামতলীর এমএস টাওয়ারের সিএন্ডএফ প্রতিষ্ঠান এসজিএস কোম্পানি। চীন থেকে আসা চালানটির বিপরীতে গত ১৬ অক্টোবর বিল অব এন্ট্রি (সি-১৬০৪১৫৫) সাবমিট করা হয় কাস্টম হাউসে। চালানটির বিপরীতে ৫ শতাংশ হারে শুল্ক কর পরিশোধ করা হয় ১ লাখ ৫৭ হাজার টাকা।’

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি এবং ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে মানিলন্ডারিং হয়। এ যাবৎ আমরা দুটি মামলা করেছি। এক পণ্য ঘোষণা দিয়ে অন্য পণ্য আমদানি করা দুটি মামলা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মানিলন্ডারিং কাজের কতিপয় কাস্টম কর্মকর্তা, সিএন্ডএফ এজেন্ট, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান জড়িত। দুর্নীতিবাজ কাস্টমস কর্মকর্তাদের সিগন্যাল ছাড়া কোন আমদানিকারকই মানিলন্ডারিং করার সাহস করবে না। তবে অনেকগুলো ঘটনা তদন্তাধীন রয়েছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে এ পাচার ঠেকানোর জন্য অ্যান্টি মানিলন্ডারিং কমিটি করা হয়েছে। তারা কাজ করছে। ধীরে ধীরে সব বন্ধ হবে।’

মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) চীন থেকে ৩০ লাখ টাকা মূল্যের স্ট্যাপল ফাইবার বা তুলা আমদানি করার কথা ছিল সৈয়দ ট্রেডার্সের। কিন্তু তুলার বদলে ৯১৬ ব্যাগ (২০ টন) বালু আসায় চালানটি আটক করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ। নগরীর ইপিজেড এলাকার বেসরকারি কনটেইনার ডিপো কিউএনএস ডিপোতে ৪০ ফুটের কনটেইনার ভর্তি পণ্যের কায়িক পরীক্ষা করার পর বিষয়টি কাস্টম কর্মকর্তার কাছে ধরা পড়ে।

গত ৯ অক্টোবর বুধবার চীন থেকে আমদানি করা ২৫ টন সুতাভর্তি একটি কনটেইনার খোলার পর পাওয়া গেছে বালু ও মাটির বস্তা। গাজীপুরের এনজেড এক্সেসরিজ লিমিটেডের নামে চালানটি বন্দরে আসে। এক কনটেইনারের চালানটি খালাসের দায়িত্বে ছিল চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান কালকিনি কমার্শিয়াল এজেন্সিজ লিমিটেড। কাস্টম কর্মকর্তারা প্রাথমিকভাবে এটিকে মানিলন্ডারিং বলে ধারণা করেছেন। আগ্রাবাদের একটি ব্যাংক থেকে ৩২ হাজার ডলার ব্যাংকে আমদানি ঋণপত্রের (এলসি) বিপরীতে এ পণ্য আমদানি হয়।

গত বছরের ৭ মে ঢাকার আমদানিকারক লোটাস সার্জিক্যাল এক হাজার ৭টি হুইল চেয়ার ও ৪৫০ পিস ক্রেচ প্লাস ওয়াকার আমদানির ঘোষণা দেয়। অথচ তিনটি কন্টেইনারের মধ্যে এক কন্টেইনারে মাত্র ৪০টি হুইল চেয়ার পাওয়া যায়। বাকি দুটি কন্টেইনারে কার্টনভর্তি ইট নিয়ে আসা হয়। ওই চালানটি আমদানি করতে ৭১ হাজার ডলারের ঋণপত্র (এলসি) খুলে আমদানিকারক। প্রতি ডলার ৮৪ টাকা হিসেবে এর মূল্য দাঁড়ায় ৫৯ লাখ ৬৪ হাজার টাকা।

গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর বালুভর্তি একটি কন্টেইনারের চালান আটক করে কাস্টমস। ঢাকার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান প্রগ্রেস ইমপেক লিমিটেড ‘কাগজ’ আমদানির ঘোষণা দিয়ে ৪১০ বস্তা বালু নিয়ে আসে। ব্যাংকের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি চীনে ১৫ হাজার ডলার পাঠিয়েও দেয়। এভাবে প্রতিনিয়ত পণ্য আমদানির নামে মানি লন্ডারিং হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস দিয়ে আলোচিত এ তিনটি ঘটনায় ১ লাখ ১৮ হাজার ডলার পাচার হয়েছে। যার মূল্যমান বাংলাদেশি প্রায় এক কোটি টাকা।

ইস্ট ডেল্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মু. সিকান্দার খান বলেন, ‘কতিপয় দুর্নীতিবাজ ব্যক্তির মাধ্যমে দেশের প্রচুর টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ পাচার ঠেকানো জরুরি। এর জন্য মানি লন্ডারিংয়ে জড়িত সকলকে আইনের আওতায় আনতে হবে।’

এএস/এসএস/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!