আনসারের অর্ধকোটি টাকা মেরে খেয়ে মোটাতাজা তিন কর্তা

গ্রামভিত্তিক মৌলিক প্রশিক্ষণ ভাতা, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও দুর্গাপূজায় দায়িত্বরত স্বেচ্ছাসেবী আনসার সদস্যদের ভাতার অর্ধকোটি টাকা আত্মসাত করার অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলা আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তাসহ তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।

উপজেলার প্রতিটি নিয়োগ ছাড়াও গ্রামভিত্তিক বিভিন্ন বিষয় ও ট্রেডে লোক পাঠাতে উৎকোচ ছাড়া মেলে না দেনদরবার। এছাড়া ক্ষমতা অপব্যবহার ও নানা অজুহাতে পুরাতন কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ বাণিজ্য হওয়ার কথা জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। অভিযুক্তরা হলেন মিরসরাই উপজেলা আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম, প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা পিন্টু ও প্রশিক্ষিকা কামরুন নাহার। বর্তমানে তিনজনই উপজেলায় কর্মরত আছেন।

জানা যায়, গত জাতীয় নির্বাচনে মিরসরাই উপজেলায় ১০৪টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে প্রতিটিতে ১২ জন করে মোট এক হাজার ২৪৮ জন আনসার সদস্য কর্তব্যরত ছিলেন। আনসার দলপতিদের মাধ্যমে এসব সদস্য সংগ্রহ করা হয়। প্রতিটি কেন্দ্রে একজন প্লাটুন কমান্ডার (পিসি), একজন সহকারী প্লাটুন কমান্ডার (এপিসি) ও ১০ জন (পুরুষ ও মহিলা) আনসার সদস্য নিয়োজিত ছিল।

যেভাবে নির্বাচনী ডিউটির টাকা আত্মসাৎ করা হয়
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্বপালনের জন্য পিসি ও এপিসিকে সরকার থেকে ভাতা বরাদ্দ দেওয়া হয় ৫ হাজার ৫০০ টাকা করে। অন্যদিকে প্রতিজন সদস্যের জন্য ভাতা বরাদ্দ ছিল ৪ হাজার ৫০০ টাকা। উপজেলার ১০৪টি ভোট কেন্দ্রে ১২ জন করে লোক দায়িত্ব পালনের কথা থাকলেও নিয়োগ দেওয়া হয় ১১ জন। নির্বাচনের পরে উপজেলা আনসার কর্তৃপক্ষ গত ৩ জানুয়ারি পিসি, এপিসি ও আনসার সদস্য (পুরুষ ও মহিলা) নির্বাচনী ভাতা দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে ব্যানার টাঙ্গিয়ে ওইদিন শুধু মাত্র পিসি ও এপিসিদের টাকা দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করে।

জানা গেছে, নয়জন করে ১০৪টি কেন্দ্রে মোট ৯৩৬ জন আনসার সদস্যের তাদের দলপতিদের মাধ্যমে জনপ্রতি ৪ হাজার ৫৬৭ টাকার মধ্যে দেওয়া হয়েছে মাত্র তিন হাজার টাকা। জালিয়াতি ধামাচাপা দিতে মাস্টাররোলের রেজিস্টার খাতায় স্ব স্ব ব্যক্তির স্বাক্ষর না নিয়েই টাকা দেওয়ার কাজটি করা হয়েছে। এতে প্রায় ১৪ লাখ ৬৬ হাজার ৭১২ টাকা ও বাকি একজনকে নিয়োগ দেখিয়ে ৪ লাখ ৭৪ হাজার ৯৬৮ টাকাসহ নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারী ১২ জন সদস্যের নামে মোট ১৯ লাখ ৪১ হাজার ৬৮০ টাকা আত্মসাৎ করা হয়।

যেভাবে দুর্গাপূজার ডিউটির টাকা আত্মসাৎ করা হয়
মিরসরাই উপজেলায় ৮৪টি কেন্দ্রে প্রতি কেন্দ্রে চারজন পুরুষ ও দুজন মহিলা করে মোট ৫০৪ জন আনসার সদস্য (স্বেচ্ছাসেবী) নিয়োগ দেয় সরকার। সবার জনপ্রতি ৫০০ টাকা করে ৫ দিনের ২ হাজার ৫০০ টাকা ভাতা নির্ধারণ করা হয়। প্রত্যেক সদস্যকে দলপতিদের মাধ্যমে এক হাজার টাকা দেওয়া হয়। এতে ৩৩৬ জনকে এক হাজার ৫০০ টাকা করে কম দিয়ে ৫ লাখ ৪ হাজার টাকা এবং দুই সদস্যকে অনুপস্থিত দেখিয়ে ১৬৪ জনের কাছ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকাসহ সবমিলিয়ে ৯ লাখ ২৪ হাজার টাকা কেবল দুর্গাপূজায় আত্মসাৎ করা হয়।

যেভাবে প্রশিক্ষণের টাকা আত্মসাৎ করা হয়
২০১৮ সালের জুলাই থেকে এ পর্যন্ত সরকারিভাবে ৪-৫টি গ্রামভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিয়েছে মিরসরাই উপজেলা কার্যালয়। এর প্রতিটিতে ৬৪ জন পুরুষ ও মহিলা প্রশিক্ষণ নেয়। সরকারিভাবে প্রতিদিন ১৫০ টাকা করে ১০ দিনের ট্রেনিং ভাতা দেওয়া হয় ১৫০০ টাকা। অথচ ১৫০০ টাকার মধ্যে জনপ্রতি দেওয়া হয়েছে মাত্র ৫০০ টাকা। প্রতিটি প্রশিক্ষণে সদস্যেদের ভাতা ৬৪ হাজার টাকাসহ এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচটি প্রশিক্ষণের ভাতা বাবদ মোট ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়।

সূত্র জানিয়েছে, মিরসরাই উপজেলায় ইউনিয়ন ও উপজেলায় স্থায়ী নিয়োগ পেতে মাস্টাররোলে নিয়োগকৃত প্রশিক্ষণার্থীদের উপজেলা থেকে প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়। এ প্রশিক্ষণ নেওয়ার আগে ওইসব স্বেচ্ছাসেবীকে মোটা অংকের টাকা উৎকোচ দিতে হয়। না দিলে তাদের প্রশিক্ষণে পাঠানো হয় না। কথামতো টাকা দিতে না পারায় যোগ্য অনেককে বাদ দিয়ে ওই স্থানে নতুন লোক নিয়োগ দিয়ে প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়েছে – এমন নজিরও আছে। এছাড়া দীর্ঘদিন চাকরি করার পরও ইউনিয়ন ও উপজেলা কোম্পানী কমান্ডারদের অনেককে নানা অজুহাতে চাকরিচ্যূত করে মাস্টাররোলে নতুন লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সবই শুধুমাত্র অর্থের জন্য।

একই ব্যক্তির দুই চাকরি
জানা যায়, উপজেলা কর্মরত বিভিন্ন কমাণ্ডার ও দলপতিদের অনেকেই আইনভঙ্গ করে একইসঙ্গে দুই জায়গায় সরকারি ও প্রাইভেট চাকরিতে নিয়োজিত রয়েছেন। উপজেলা কর্মকর্তাকে উৎকোচ দিয়ে সরকারি ভাতা গ্রহণ করার নজির রয়েছে এসব দলপতির বিরুদ্ধে।

অভিযুক্ত এসব ব্যক্তির মধ্যে রয়েছেন মো. সোহাগ, তিনি মিরসরাই উপজেলা ২ নম্বর হিঙ্গুলী ইউনিয়নের দলপতি এবং প্রগতি লাইফ ইনসুরেন্সের বারইয়ারহাট শাখার অ্যাকাউন্টেন্ট হিসেবে কর্মরত। অন্যদিকে সিদ্দিক আহমদ ১২ নম্বর খৈয়াছড়া ইউনিয়নের দলপতি এবং তিনি আবার আনসার ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংকেও কর্মরত।

জানা যায়, ২০১৮ সালের জুলাইয়ে জাহাঙ্গীর আলম যোগদান করেন উপজেলা কর্মকর্তা হিসেবে। যোগদানের পর থেকে তিনি অনিয়মিত থাকেন কর্মস্থলে। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি ইউনিয়ন ও এলাকায় যাওয়া কথা থাকলেও পরিদর্শন করেননি বেশিরভাগ ইউনিয়ন ও এলাকায়। সরকারের পক্ষ থেকে কোন সুবিধা বা বরাদ্দ বিষয়ে কোন তথ্য ঘোষণার পরই কেবল নিয়মিত অফিস করেন তিনি। সরকারের প্রতিটি কর্মকাণ্ডে অধীনস্ত কর্মকর্তা ও বিভিন্ন স্তরের কমান্ডার ও দলপতিদের কাছ থেকে উৎকোচ নিয়ে কাজ করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন সাবেক কমাণ্ডার ও দলপতি জানান, দেড় বছর আগে উপজেলা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম কাজে যোগদানের পর থেকেই ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনিয়ম করে সরকারি ভাতা আত্মসাৎ করে আসছেন। তাকে টাকা দিলে চাকরি মেলে কিংবা প্রশিক্ষণ ও কমাণ্ডারদের স্থায়ী নিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়। টাকা দিতে না পারায় অনেককে নিয়মভঙ্গ করে চাকরিচ্যূতও করেছেন তিনি।

আইনে বলা আছে, বাংলাদেশ আনসার নীতিমালা ২০১৭ অনুযায়ী উপজেলা আনসার কোম্পানী ও উপজেলা আনসার প্লাটুন ও ইউনিয়ন আনসার প্লাটুন সদস্য ও সদস্যগণ (স্বেচ্ছাসেবী) নিয়োগ ও অব্যাহতি এ নীতিমালার আওতায় নিয়োজিত বলে বিবেচিত হবেন এবং নীতিমালার অনুচ্ছেদ ৬ (ক) অনুযায়ী ৫৯ বছর বয়সকাল পর্যন্ত কর্মরত থাকবেন।

অথচ এ আইন লঙ্গন করে দীর্ঘদিন ধরে মাস্টাররোলে চাকরি করা ইউনিয়ন ও উপজেলা কমান্ডার ছাড়াও দলপতিদের বিভিন্ন অজুহাতে চাকরিচ্যূত করা হয়। এভাবে চাকরিচ্যূত ইউনিয়ন কমাণ্ডারদের মধ্যে রয়েছেন নুরুল ইসলাম, মো. চাঁন্দ মিয়া, মজিবুল হক, মো. ফারুক ও মো. মহিউদ্দিন। এছাড়া ইউনিয়ন কমাণ্ডার মজিবুর রহমানকে বাদ দিয়ে নতুন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে মো. জামাল নামের এক ব্যক্তিকে।

মিরসরাই উপজেলা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ বলা হয়েছে তা সঠিক নয়৤ দীর্ঘদিন চাকরি করার কারণে ঈর্ষান্বিত হয়ে ষড়যন্ত্র করছে কেউ কেউ। আমার জানামতে একজনের চাকরি চলে যাওয়ার কারণে তিনিই মূলত এ ধরনের প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছেন৤’

চট্টগ্রাম জেলা সার্কেল এডজুট্যান্ট টিুট মিয়া চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘উপজেলা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ভিত্তিতে তদন্ত করা হবে। তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেলে তাহলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হবে।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!