আত্মসমর্পণের আগেই চট্টগ্রামে উড়ল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা

পাকিস্তানি বাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের একদিন আগেই পাকিস্তানের পতাকা নেমে গিয়েছিল চট্টগ্রাম থেকে। ১৭ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের আগের দিনই বিশ্বের বুকে জন্ম নেওয়া নতুন দেশ বাংলাদেশের পতাকা উড়েছিল চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে।

একাত্তরের নভেম্বর থেকে পিছু হটতে থাকে পাকিস্তানি সেনারা। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটে।
১৬ ডিসেম্বর বিকেলে যখন ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান চলছে, তখন চট্টগ্রামের ভাটিয়ারীতে সহযোদ্ধাদের নিয়ে সন্তর্পণে এগিয়ে চলেছেন মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার আজিজ। লক্ষ্য পাকিস্তানি সেনাদের ঘাঁটি। ছোট একটি খাল অতিক্রম করছিলেন তারা। হঠাৎ তাদের মাঝখানে এসে পড়ল পাকিস্তানিদের ছোড়া কামানের গোলা। মারাত্মক আহত হন সুবেদার আজিজ। সঙ্গে ১৫ বছরের এক কিশোর মুক্তিসেনা। কিছুক্ষণ পরই মারা যান এই দুজন।

আগের দিন ভাটিয়ারীর কাছের একটি গ্রাম হানাদারমুক্ত হয়। ওই গ্রামেই ছিল ওই কিশোরের বাড়ি। ১৫ ডিসেম্বর মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে তাকে ১২ ঘণ্টার জন্য ছুটি দিয়েছিলেন সেক্টর কমান্ডার রফিকুল ইসলাম। কিন্তু সেই কিশোর বলেছিল, চট্টগ্রাম শহর মুক্ত করে তবেই সে বাড়ি যাবে, তার আগে নয়। তার মৃত্যুর এক দিন পর তারই বয়সী আরেক কিশোর সেখানে উড়িয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।

১৬ ডিসেম্বর বিকেলের ওই লড়াইয়ের কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানি এক মেজর সাদা পতাকা হাতে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসেন ভাটিয়ারীর ওই খালের পাড় পর্যন্ত। মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম বলেন, ‘পাকিস্তানি ওই মেজর সাদা পতাকা হাতে এসে আমাকে জানালেন, নিয়াজী তাদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছেন। আমি বললাম, কাল আনুষ্ঠানিকভাবে এই আত্মসমর্পণ হবে ক্যান্টনমেন্ট ও নেভাল বেইজে।’

রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি রাতে আর শহরে ঢুকলাম না। পরদিন সকাল নয়টার আগেই আমি জনতার ভিড় ঠেলে সার্কিট হাউসে ঢুকলাম। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাকিস্তানি সেনারা ক্যান্টনমেন্ট ও নৌঘাঁটিতে পালাচ্ছিল। সেখানেই তাদের আত্মসমর্পণ হয়। আর সার্কিট হাউস তখন জনসমুদ্র।’

চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে তখনেও উড়ছিল পাকিস্তানের পতাকা। রফিকুল ইসলাম তার সঙ্গে আনা ছোট্ট প্যাকেটটি খুললেন। প্যাকেটে ভাঁজ করে রাখা বাংলাদেশের পতাকাটি তুলে নিলেন তিনি। তুলে দিলেন এক কিশোরের হাতে। সে উড়িয়ে দিল পতাকাটি।

লে. কর্নেল (অব.) হালদার মোহাম্মদ আবদুল গাফফার বীর উত্তমের বর্ণনায় আত্মসমর্পণের দৃশ্যটি এ রকম— দুপুরের পর থেকেই পাকিস্তানি ইউনিটগুলোকে আত্মসমর্পণের জন্য চট্টগ্রাম ক্লাবের মাঠে সমবেত করা হচ্ছিল। বিকেল সাড়ে চারটায় সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এল। এ ছিল এক অভাবনীয় দৃশ্য। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনীর অফিসার ও জওয়ানরা সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে। সবার অস্ত্র তাদের পায়ের কাছে রাখা। কারও মুখে কোনো কথা নেই। লে. জেনারেল সাগাত সিং পাকিস্তানের সবচেয়ে সিনিয়র অফিসার কমোডর জেড কামালকে নির্দেশ দিলেন তার সেনাদের অস্ত্রসমর্পণের। পাকিস্তানিরা পায়ের কাছে রাখা অস্ত্র সেখানেই রেখে তিন কদম পিছে সরে গেল। এরপর ভারতীয় সেনারা ওই সব অস্ত্র সংগ্রহ করে তাদের হেফাজতে নিয়ে গেল। পাকিস্তানি সব সেনার র‌্যাংক ব্যাজ খুলে নেওয়া হয়। তাদের কোমরের বেল্ট অপসারিত হয়।

মেজর রফিকুল ইসলামের ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ বইয়ে বলা হয়েছে, ‘চট্টগ্রামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ১৬১ জন অফিসার, ৩০৫ জন জেসিও এবং নৌ ও বিমানবাহিনীর সমপর্যায়ের লোক এবং তিন বাহিনীর ৮ হাজার ৬১৮ জন সৈন্য আত্মসমর্পণ করে।’

মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘চট্টগ্রামে জনতা আগে বাংলাদেশের পতাকা তুলেছিল। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ করে। আমাদের এক নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম ১৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে পৌঁছাতে পারেননি, যেখানে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। পরদিন আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হয়েছিল। কিন্তু চট্টগ্রামের জনতা নিজেরাই বিভিন্ন জায়গায় নিজ উদ্যোগে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তুলে দেয়। সার্কিট হাউজেও একদিন আগেই বাংলাদেশের পতাকা উঠেছিল, যদিও আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান হয়েছে একদিন পরে।’

মুক্তিযোদ্ধা এবিএম খালেকুজ্জামান দাদুল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকালের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘যুদ্ধের শেষদিকে আমি দেওয়ানবাজারে আমার এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নিই। ১৬ তারিখ সকালে আমি একটা রিকশা নিয়ে সার্কিট হাউজের সামনে আসি। তখনও বিভিন্ন জায়গায় গোলাগুলি হচ্ছিল। এর মধ্যেও আবার জনতা মিছিল বের করে উল্লাস করছিল। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যেভাবে হোক আমি সার্কিট হাউজে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা তুলব। সার্কিট হাউজে গিয়ে দেখি, লুটতরাজ চলছে। কেউ কেউ আসবাবপত্র নিয়ে বাইরে ফেলে দিচ্ছে। কেউ নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে টর্চার সেল বানানো হয়েছিল। যে চেয়ারে বসিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের টর্চার করা হত, আমি সেটা দেখেছিলাম।’

তিনি বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে সেখানে যাই। নিজে স্ট্যান্ডে উঠতে পারিনি। চট্টগ্রাম কলেজের একজন ছাত্র ছিল, শামীম। তাকে তুলে দিই। সে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে ফেলে। আমি বাংলাদেশের পতাকা তাকে দিই। সে সেটা বেঁধে দেয়।’

মুক্তিযোদ্ধা-সাংবাদিক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘১৫ ডিসেম্বর কুমিরার দক্ষিণে পাকিস্তানিদের কতগুলো অস্থায়ী ডিফেন্স ভেঙে যৌথবাহিনী ভাটিয়ারিতে পৌঁছে যায়। সেখান থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রবল প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি করেছিল। এখানে ১৬ ডিসেম্বর প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ হয়। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটতে থাকে। পালানোর সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ভাটিয়ারি অংশে তারা একটি সেতু ধ্বংস করে দিয়ে যায়। যে কারণে চট্টগ্রামের পথে আগুয়ান মুক্তিযোদ্ধা-স্বেচ্ছাসেবক ও ভারতীয় বাহিনীর অগ্রযাত্রা বিলম্বিত হয়। ১৬ ডিসেম্বর সারা রাত সেতুর পাশে খালের মধ্যে একটি বিকল্প সড়ক তৈরি করা হয়। এরপর বাংলাদেশ বাহিনী দ্রুত বিনা বাধায় চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করে তারা। ১৭ ডিসেম্বর সকাল সোয়া ৯টায় চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘সেদিন ছিল শীতের সকাল। মেঘমুক্ত নীল আকাশের নিচে সূর্যালোকে অলস ঢেউয়ের মতো দুলেছিল বাংলার লাল-সবুজ পতাকা। শহরের প্রতিটি প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ, মুক্তিযোদ্ধা, জনতার বাঁধভাঙা স্রোতের মতো ছুটে আসছিলেন সার্কিট হাউসের দিকে। তাদের কণ্ঠে ছিল বিজয়ের জয়ধ্বনি।’

১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের পর চট্টগ্রামে বিজয়ের পতাকা প্রথম উড়েছিল পলোগ্রাউন্ড ময়দানে। ওইদিনই চট্টগ্রামকে পাকস্তানিদের দখলদারিত্ব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করেন বাংলাদেশের বীর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনী। চট্টগ্রামকে শত্রুমুক্ত করার পরই পলোগ্রাউন্ড ময়দানের পাশে স্থাপন করা হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ১ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডারের সদর দপ্তর। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় যখন পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করছিল, তখনও চট্টগ্রামের কোথাও কোথাও মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সঙ্গে চট্টগ্রামে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর যুদ্ধ চলছিল।

একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা চট্টগ্রাম ১ নম্বর সেক্টরের অধীনে ২ নম্বর সাব-সেক্টরের সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা মো. মোস্তফা কামাল বলেন, ‘চট্টগ্রাম মুক্ত হওয়ার পর ভোর হওয়ার আগেই ১ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তর স্থাপিত হয়েছিল পলোগ্রাউন্ড ময়দানের পাশে। ১৭ ডিসেম্বর সকাল সাতটায় ১ নম্বর সেক্টরের উপ-অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মাহফুজুর রহমান একটি লম্বা বাঁশের শীর্ষে বাংলাদেশের পতাকা বেঁধে পলোগ্রাউন্ড ময়দানে চট্টগ্রামে বিজয়ের পতাকা প্রথম উড়িয়ে দেন। সকাল আনুমানিক আটটার দিকে সদর দপ্তরে আসেন সেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম। তিনি সেখানে এসে সদর দপ্তরে সমবেত সকল মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে সামরিক কায়দায় চট্টগ্রামের মুক্ত মাটিতে প্রথম উত্তোলিত জাতীয় পতাকাকে স্যালুট প্রদান করেন।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!