আতঙ্কে রোগী দেখা বন্ধ চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতালে!

ডাক্তারদের নিরাপত্তা সরঞ্জামের অভাবই মূল কারণ

সপ্তাহখানেকের জন্য নরসিংদী থেকে চার বছরের ছোট শিশু লাবিবাকে নিয়ে মা লাভলী আক্তার বেড়াতে আসেন বড় ভাইয়ের বাসা চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদে। কিন্তু এর মধ্যেই দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার দূরপাল্লার সকল যানবাহন বন্ধ করে দিলে বাড়ি আর ফেরা হয় না লাভলীর। এদিকে তিন দিন ধরে জ্বর সর্দি আর ডায়রিয়ায় ভুগছে ছোট্ট লাবিবা। বাসার পাশের ফার্মেসি থেকে ওষুধ এনে খাওয়ালেও তেমন একটা উন্নতি নেই। লাবিবার মামার বন্ধুর পরিচিত এক শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বসেন নগরীর ওআর নিজাম রোডের সিএসসিআর হাসপাতালে। সকাল থেকে সিরিয়াল নিতে কয়েক দফা ফোন করেও সাড়া না পেয়ে সিদ্ধান্ত নেন বিকালে চিকিৎসকের কাছে চলে যাবেন। রাস্তাঘাটে গণপরিবহন না থাকলেও ভাগ্নির এমন অসুস্থতায় চুপ থাকতে পারেননি মামা সাইদুল করিম। পরিচিত ভাড়া করা সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে গেলেন হাসপাতালে। হাসপাতালে পা রাখতেই হতাশ হলেন তিনি। এতো ঝক্কি-ঝামেলার পরে হাসপাতালে এলেও লাবিবাকে চিকিৎসক দেখানো গেলো না। চিকিৎসক চেম্বারে নেই। চেম্বারের বাইরে ঝুলছে নোটিশ।

গত ২৩ মার্চ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য রোগী দেখা বন্ধ রেখেছেন সেই শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। বাধ্য হয়ে হেঁটে হেঁটে পাশে থাকা আরেক হাসপাতাল রয়েল হাসপাতালে গেলে সেখানেও একই অবস্থা। কেবল সিএসসিআরে এমন হয়েছে তা কিন্তু নয়। নগরীর প্রায় বেসরকারি হাসপাতালেই এখন ঝুলছে এমন নোটিশ। নোটিশে লেখা আছে চিকিৎসক রোগী দেখবেন না। আবার যারা রোগী দেখছেন তাদের কেউ কেউ নোটিশ দিয়েছেন জ্বর ও সর্দি-কাশির রোগী দেখা হবে না। এভাবে একটি-দুটি নয়, বেসরকারি হাসপাতালের নিজস্ব চেম্বারে বেশিরভাগ চিকিৎসকই রোগী দেখা বন্ধ রেখেছেন অনির্দিষ্টকালের জন্য।

আগে এমনটি কখনও ঘটেনি তবে বাংলাদেশে করোনা শনাক্ত হওয়ার পর পরই অল্প-স্বল্প এমন চিত্র দেখা গেলেও ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে যায় প্রায় সব চিকিৎসকের মধ্যেই। কারণ অজ্ঞাত রাখলেও চিকিৎসকদের অনেকেরই দাবি, নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে তারা রোগী দেখা বন্ধ করেছেন। এর মধ্যে ঢাকায় চার চিকিৎসক করোনাভাইরাস সন্দেহে হোম কোয়ারেন্টাইনে যাওয়ার পরেই হঠাৎই রোগী না দেখার হার বেড়ে প্রায় অনেক। সরকারি হাসপাতালের বাইরে রোগী দেখা অনেকটা শূন্যের কোঠায় চলে গেছে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে।

একটি-দুটি নয়, বেসরকারি হাসপাতালের নিজস্ব চেম্বারে বেশিরভাগ চিকিৎসকই রোগী দেখা বন্ধ রেখেছেন অনির্দিষ্টকালের জন্য।
একটি-দুটি নয়, বেসরকারি হাসপাতালের নিজস্ব চেম্বারে বেশিরভাগ চিকিৎসকই রোগী দেখা বন্ধ রেখেছেন অনির্দিষ্টকালের জন্য।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য চিকিৎসক ও নার্সদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া ভীতি এবং পাশাপাশি তাদের মধ্যে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জামের অভাব— তা বেসরকারি হাসপাতালের চেম্বারে চেম্বারে টাঙানো নোটিশেই অনেকটাই প্রকাশ হয়ে পড়েছে। তবে এতে প্রচণ্ড ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ রোগীরা। সাধারণ অসুস্থতা নিয়েও কাঙ্খিত চিকিৎসককে দেখাতে পারছেন না অনেক রোগী।

সরকারি হাসপাতালে যদিও পিপিই (পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট) দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা এখনও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। এ কারণেই মূলত অনেক চিকিৎসক জ্বর সর্দি-কাশির রোগী ছাড়াও অন্য রোগী দেখাও বন্ধ করে দিয়েছেন। অথচ অনেক মানুষই চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালের চাইতে প্রথমে বেসরকারি হাসপাতালে যান।

নগরীর বেসরকারি হাসপাতাল ম্যাক্স হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা রোগী দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন। অন্যদিকে গণপরিবহন বন্ধ থাকায়ও অনেক রোগী আসতে পারছেন না চিকিৎসাসেবা নিতে। যদিও ম্যাক্স হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা হটলাইনের মাধ্যমে আপাতত রোগীদের চিকিৎসা পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। চিকিৎসাকর্মীদের নিরাপত্তার জন্য মাস্ক-গাউনের মত প্রয়োজনীয় উপকরণের স্বল্পতা এ হাসপাতালেও রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্বাস্থ্যকর্মী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা স্বাস্থ্যকর্মীরা সেবা দেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত। কিন্তু আমরা আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। সরকারি হাসপাতালগুলোতে পিপিই পাঠানো হচ্ছে বলে শুনেছি। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালে নিজেদের উদ্যোগে এগুলো কেবল শুরু হয়েছে। তাছাড়া কেউ জানি না কার শরীরে এই ভাইরাস আছে। আমাদের কিছু হলে অসুস্থ রোগীদের সেবা দেওয়া কি আসলেই সম্ভব? এটা যেন কারও মাথায় নেই।’

দেশে এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছেন ৪৮ জন। তার মধ্যে চিকিৎসকও রয়েছেন। এদিকে মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে পিপিই ছাড়াই রোগীদের সেবা নিশ্চিত করতে। তবু অজানা আতঙ্কে বেসরকারি হাসপাতালে নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়া রোগী দেখাই বন্ধ করে দিয়েছেন চিকিৎসকরা।

ম্যাক্স হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. লিয়াকত আলী খান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সত্য কথা, সবাই একটা প্যানিক সিচুয়েশনে আছে। আমরা-আপনারা সবাই। এখন কোন্ রোগীর করোনা আছে, কোন্ রোগীর নাই— সেটা তো বলা কঠিন। শুধু হসপিটাল না যে কোন প্রাইভেট চেম্বারেও চিকিৎসকেরা করতে চাচ্ছেন না। এটা (পিপিই) এখনও আসেনি। আমরা নিজেরা নিজেরা ম্যানেজ করেছি কিছু। কিন্তু সেটা হু (ডব্লিউএইচও) স্ট্যান্ডার্ড কিনা তা তো জানি না। তাছাড়া এ ব্যাপারে সরকার থেকে কিছুটা নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।’

ডা. লিয়াকত আলী খান বলেন, ‘আমার ম্যাক্সের জন্য হটলাইন চালু করেছি। হটলাইনেই পরামর্শ দিচ্ছি রোগীদের। এছাড়া তো কিছু করার নাই। আমাদের এখানে বলতে গেলে রোগীই নাই। এখন যেমন রাস্তাঘাট বন্ধ। আবার কেউ কেউ হোম কোয়ারেন্টাইন মেইনটেইন করছে।’

নিরাপত্তা সরঞ্জাম প্রসঙ্গে রয়েল হাসপাতাল প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপক নুরুল আমিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি। আসলে এটা কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। তারপরও কিছু সেলাই করতেছি। তবে ওয়ান টাইম ব্যবহারের জন্য কিছু রাখা আছে। আবার প্রতিদিন একসাথে এতজনকে একটা করে দেওয়া সম্ভবও না। তাছাড়া আমাদের এখানে তিন শিফটে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ জন চিকিৎসক হবেন। এই মুহূর্তে রোগী অনেক কম। এখন চিকিৎসকেরা যদি নিজেরা আতঙ্কিত হয় তাহলে রোগীদের অবস্থা কোথায় তা আপনিও বুঝতেছেন।’

এদিকে নিরাপত্তা সরঞ্জাম প্রসঙ্গে বিএমএর সাধারণ সম্পাদক ডা. ফয়সাল ইকবাল চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন,’ সরকারি হাসপাতালে সরকার পিপিই দিচ্ছে। এখন বেসরকারি হাসপাতালগুলো সেভাবে দিতে পারছে না এটা সত্যি। কেউ কেউ নিজেদের স্বার্থেই নিজ উদ্যোগে সংগ্রহ করে নিচ্ছে। আবার পয়সা দিয়েও এটা পাওয়া যাচ্ছে না। যদি এগুলো সহজলভ্য হতো তাহলে কিছু হলেও সাহস পাইতো চিকিৎসকরা।’

ডা. ফয়সাল ইকবাল চৌধুরী বলেন, ‘চেম্বারে রোগী নাই তেমন। আমি আমার পাঁচটা রোগীর জন্য রাঙ্গুনিয়া গেছি। কিন্তু সবাই তো আমার মত না। আর কেউ যদি চেম্বারে বসতে না চায়। তাহলে তাকে তো জোর করা যাবে না। যেসব রোগীর ইমারজেন্সি সেবা দরকার তারা হাসপাতালে যাচ্ছে, চেম্বারে আসছে না। ইমারজেন্সি রোগীরা ব্যক্তিগত চেম্বারে যায় না। তাই অনেকেই চেম্বার করতে চাচ্ছে না।’

নিরাপত্তা প্রসঙ্গে চিকিৎসকদের এ নেতা যোগ করে বলেন, ‘চট্টগ্রামে অনেক চিকিৎসক। প্রায় সাত হাজার রেজিস্টার্ড চিকিৎসক রয়েছে। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ সরকারি। বাকি পাঁচ হাজার বেসরকারি হাসপাতালে আছে। কেউ চেম্বার করছে। কেউ ক্লিনিকে আছে। কেউ নিজেদের মতো করে বসছে। হাসপাতালগুলো পিপিই অল্পস্বল্প দিচ্ছে কিন্তু তেমন পাচ্ছি না তো। যদি আপনি আমাকে দেন আমি আপনাকে টাকা দেব। এই ১০০টা পিপিই’র জন্য বিএমএ থেকে ডোনেশন নিয়ে ঢাকায় পাঠিয়েছি প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। কিন্তু তারা পর্যাপ্ত পায় নাই বলে আমাদেরকে পাঠাইছে পঞ্চাশটা। তাছাড়া এসব কতটা হু (ডব্লিউএইচও) স্ট্যান্ডার্ড অনুসারে তৈরি হচ্ছে তাও আমার বোধগম্য না। আর এখন অনেকেই এ নিয়ে ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে। সরকার যদি এগুলো সহজলভ্য করে দিতো তাহলে চিকিৎসকরাও সাহস পাইতো রোগীদের সেবা দিতে।’

এদিকে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের ঘাটতি নিয়ে অভিযোগ করেছেন অনেক চিকিৎসক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘চিকিৎসক-নার্সদের নিরাপত্তাকে সরকার আদৌ কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে তা সবাই বুঝতে পারছে। চিকিৎসকদের যদি প্রটেকশন না থাকে, তারা নিজেরাই যদি রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকে বা আক্রান্ত হয় তাহলে চিকিৎসা দেবে কারা? রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে এখন ঢাকায় কয়েকজন চিকিৎসকও করোনায় আক্রান্ত। তাহলে আমাদের কী হবে? আমাদেরও তো পরিবার আছে। নিজে বাঁচলে বাপের নাম।’

করোনা ভাইরাসের কারণে চিকিৎসকরা রোগী দেখছেন না। অন্যদিকে চিকিৎসকরা বলছেন, নিরাপত্তা সরঞ্জাম না থাকায় রোগী দেখতে আগ্রহ পাচ্ছেন না। তাই বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবা দেওয়া বন্ধ রেখেছেন বেশিরভাগ চিকিৎসক।

এ প্রসঙ্গে সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘কোনো চিকিৎসক যদি চায় এই মূহূর্তে তার বাড়তি আয়ের প্রয়োজন নেই। তাই সে চেম্বার বা হাসপাতালে প্রাকটিস করবে না তাহলে তাকে জোর করার সুযোগ নাই। তাছাড়া মন্ত্রণালয় থেকে সকল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। চাইলেও কেউ তার দায়িত্বে ফাঁকি দিতে পারবে না।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!