আগুনের ঝুঁকিতে চট্টগ্রামের ৫ মার্কেটের ৪১ স্পট, পানির মজুদই নেই আশেপাশে

দেড় হাজার টাকার অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র কিনতে ব্যবসায়ীদের অনীহা

চট্টগ্রাম নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজারের তামাকুমন্ডি লেনে জলসা মার্কেটের ব্যবসায়ী রাশেদুল ইসলাম। প্রায় এক যুগ ধরে একটি জুতার দোকান দিয়ে ব্যবসা করছেন এই মার্কেটে। চলাচলের রাস্তা থেকে নিচে বেসমেন্টে রয়েছে তার দোকান। ছোট দোকানটিতে মালামাল রাখা হয়েছে গাদাগাদি করে। পাশের দোকানগুলোরও অবস্থা একই। কিন্তু এই মার্কেটের কোনো দোকানেই নেই অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র। এমনকি আগুন লাগলে বেরোবার পথও নেই পর্যাপ্ত। ফলে যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার সম্ভাবনা রয়েছে।

আগুনের ঝুঁকিতে চট্টগ্রামের ৫ মার্কেটের ৪১ স্পট, পানির মজুদই নেই আশেপাশে 1

জলসা মার্কেটের মতো একই অবস্থা চট্টগ্রাম নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজার, টেরিবাজার, জহুর হকার্স মার্কেট ও নূপুর মার্কেটের। বিশেষ করে নূপুর মার্কেটে জুতার দোকানগুলো রয়েছে বেশি ঝুঁকিতে। প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার ব্যবসা করলেও দেড় হাজার টাকায় অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র কিনতে অনীহা ব্যবসায়ীদের।

এদিকে ফায়ার সার্ভিসের তথ্য মতে, চট্টগ্রামের এসব মার্কেটের ৪১টি স্থাপনা রয়েছে বেশি ঝুঁকিতে।

জানা গেছে, এসব মার্কেটের আশপাশে নেই কোনো জলাশয়। এছাড়া নেই পানির কোনো মজুদও। রিয়াজউদ্দিন বাজারের আওতাধীন তামাকুমন্ডি লেনে অধিক ঝুঁকিতে রয়েছে নূপুর মার্কেট। সেখানে নিচতলা থেকে সাততলা পর্যন্ত জুতার দোকান। তাছাড়া রয়েছে ইলেক্ট্রনিক্স মার্কেটও। কিন্তু চলাচলের জন্য নেই পর্যাপ্ত রাস্তা।

এছাড়া রিয়াজউদ্দিন বাজারের দুটি ইউনিটের মধ্যে একটিতে রয়েছে কাঁচাবাজার ও মাছ-মাংসের এবং অপরটি তামাকুমন্ডি লেন। এই দুই ইউনিটে রয়েছে ১১০টি মার্কেট। ১৫ হাজার দোকান ঘিরে এখানকার ব্যবসায়ীর সংখ্যা আট হাজার।

নূপুর মার্কেটের ষাটোর্ধ্ব ব্যবসায়ী সাদেকুর রহমান বলেন, ‘আগুন লাগলে একসঙ্গে জ্বলবে সব। দোকানগুলো খুবই ছোট ছোট। অতি উচ্চ দাহ্য পদার্থ, ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতির কারণে আগুন দ্রুত ছড়াবে।’

তিনি বলেন, ‘আগুন লাগলে ধোঁয়ার কারণে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়ে যাবে। দোকানদাররা সরু রাস্তা দিয়ে বের হতে পারবেন না। ফায়ার সার্ভিসও দ্রুত ঢুকতে পারবে না। এখানে আশপাশে কোনো জলাশয়ও নেই।’

গত ১২ জানুয়ারি নূপুর মার্কেটের সপ্তম তলায় জুতার দোকানে আগুন লাগলে তা নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের দু’ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। তবে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লাগে প্রায় চার ঘণ্টা।

এর আগে ২০১৮ সালের ২০ এপ্রিল বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে জলসা মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

২০১৯ সালের ১৯ অক্টোবর জহুর হকার্স মার্কেটে আগুন লেগে পুড়ে যায় শতাধিক দোকান। ক্ষয়ক্ষতি হয় কয়েক কোটি টাকা। একই বছর খাতুনগঞ্জের ভেড়া মার্কেটে আগুন লেগে নয়জনের মৃত্যু হয় এবং পুড়ে যায় ২০০ ঘর-বাড়ি।

২০২১ সালে আরেক দফায় হকার্স মার্কেটে আগুন লাগলেও বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়।

এদিকে মার্কেট ঘিরে ফায়ার সার্ভিসের সুপারিশের মধ্যে রয়েছে, প্রতি ৫০০ বর্গফুট এলাকার জন্য অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র স্থাপন করা, অগ্নিনির্বাপক ও উদ্ধার বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস হতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ, অগ্নিনির্বাপক ড্রিলের ব্যবস্থা, পানি রিজার্ভারে সংরক্ষণ করা ও গলিপথসমূহ বাধামুক্ত রাখা, দৃশ্যমান স্থানে ফায়ার সার্ভিসের ফায়ার সার্ভিসের স্টেশনের নম্বর দেওয়া।

মো. জাহাঙ্গীর আলম নামের তামাকুমন্ডি লেনের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আগুন লাগলে জীবন নিয়ে বের হতে পারব কি-না জানি না। সবসময় একটা আতঙ্ক কাজ করে মনের মধ্যে।’

অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র কেন নেননি, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সমিতি থেকে কিনে দিক। আমরা নিজেরা কিনতে চাইলেও কেনা হয় না।’

নন্দনকানন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘কোনো যন্ত্রপাতি না থাকলেও প্রাথমিক পর্যায়ে কিভাবে অগ্নি নির্বাপণ করা যায়, তা হাতে-কলমে শিখিয়ে দেওয়া হয়। বহনযোগ্য অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র দিয়ে কিভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে করা যায় তাও শেখানো হয়।’

তিনি বলেন, ‘আমরা গত ১১ মার্চ টেরিবাজার ও ১৯ মার্চ তামাকুমন্ডি লেনে বণিক সমবায় সমিতির সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেছি। জহুর হকার্স মার্কেটে মোবাইল কোর্ট করেছি, ব্যবসায়ীদের বুঝিয়েছি। তারপরও ব্যবসায়ীরা সচেতন না।’

রিয়াজউদ্দিন বাজারের তামাকুমন্ডি লেনে অগ্নিঝুঁকির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এই মার্কেটের চলাচল পথ সংকীর্ণ, এবরো-থেবরো বৈদ্যুতিক লাইন, মালামালের ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। একইসঙ্গে আন্ডারগ্রাউন্ডে পানির রিজার্ভারও নেই।’

মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘সমিতির মিটিংয়ে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী কি করতে হবে, তার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে তারা ১৫০০ টাকায় অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র কিনতে উৎসাহী না। বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের পরপরই আমরা জহুর হকার্স মার্কেট, তামাকুমন্ডি লেন, টেরিবাজার পরিদর্শন করেছি, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের যে ভুলগুলো ঠিক করতে তাগাদা দিয়েছি। কিন্তু তারা যদি সেটা না করে তাহলেতো আমরা তাদের ফোর্স করতে পারি না।’

অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র কেনার বিষয়ে তামাককুন্ডি লেইন বণিক সমিতির নির্বাহী সদস্য ফজলুর রহমান বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা সমিতির দিকে চেয়ে থাকে। কখন সমিতি থেকে তাদের অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র কিনে দেবে। যেখানে তাদের লাখ টাকা প্রতিদিনের বেচাকেনা, সেখানে হাজার দেড় হাজার টাকায় অগ্নিনির্বাপক সিলিন্ডার কিনতে চান না। জীবন নিয়ে তাদের অসচেতন মনোভাব বদলানো যায়নি।’

তামাকুমন্ডি লেন বণিক সমিতির নবনির্বাচিত সভাপতি সারোয়ার কামাল বলেন, ‘রিয়াজউদ্দিন বাজার তামাকুমন্ডি কিংবা হকার্স মার্কেটের ভবনগুলো অগ্নিঝুঁকিতে আছে—এটা আমরা সবসময় বলে আসছি। আমরা মার্কেটগুলোর মালিক, দোকানদার এবং ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বসে কীভাবে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি কমানো যায়, সে বিষয়ে সমন্বয় সভা করেছি। মার্কেটগুলোয় অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র স্থাপনাসহ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় প্রতি মিটিংয়ে।’

তবে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে তিনি সমিতির সঙ্গে ব্যবসায়ীদের মতবিরোধকে দায়ী করেন।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!