হরিলুট/ আগাম স্বাক্ষরে তেল বিলি চলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কাজ ছাড়াও ব্যক্তিগত কাজেও প্রায়ই দেশের বাইরে থাকেন যান্ত্রিক বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সুদীপ বসাক। তিনি ছুটিতে থাকলেও যান্ত্রিক বিভাগের সমস্ত কর্মযজ্ঞ চলে তার অগ্রিম স্বাক্ষরে। এই কর্মকর্তার অনুপস্থিতিতে বিবরণবিহীন খালি ইস্যু স্লিপে স্বাক্ষর থাকায় কর্মকর্তা ও চালকরা নেমেছে তেল চুরির মহোৎসরে। অভিযোগ রয়েছে, বরাবরের মতোই ২৬ জানুয়ারি সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ট্রেনিং নিতে ঢাকায় যাওয়ার সময়ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সুদীপ বসাক বেশ কয়েকটি ভাউচার বইয়ের তেল স্লিপে অগ্রিম স্বাক্ষর করে রেখেছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নিজস্ব তেলের পাম্প থেকে ২০০ থেকে ২৫০টি গাড়িতে তেল দেওয়া হয়। এতে গাড়িপ্রতি তেল বরাদ্দ আছে ৫০ থেকে ৭০ লিটার। সেখানে অসৎ চালকরা দিনের শেষে গাড়িতে জমানো তেল বিক্রি করে।

এদিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সুদীপ বসাক চাকরিতে অস্বাভাবিক পদোন্নতির পাওয়ার পর একাধিকবার দেশের বাইরে গেলেও প্রতিবারই তার অনুপস্থিতিতে তার বিভাগের সকল কাজ চালানো হয় তার এই অগ্রিম স্বাক্ষরে। ওই সময় বেশ কিছু নথিপত্রে ও তেলের ভাউচার বইগুলোতে তিনি স্বাক্ষর করে রাখেন। তার ব্যবহৃত পাসপোর্ট অনুসন্ধান করলেই সময় ও তারিখের সত্যতা পাওয়া যাবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অগ্রিম স্বাক্ষরে অফিসের কার্যক্রম চলমান থাকলেও তার অনুপস্থিতে সিটি করপোরেশনের যান্ত্রিক বিভাগের বড় ধরনের কোন অপ্রীতিকর ঘটনায় পড়লে এই দায়ভার কি সুদীপ বসাক নেবেন?

নিয়ম অনুসারে সরকারি কোন প্রতিষ্ঠানের কোন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছুটিতে থাকলে মূলত তার এই দায়িত্বে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে কাজ করার কথা তার অধীনস্থ সিনিয়রের মধ্যে একজন। কিন্তু চসিকের এই নিয়ম মানা হয় না। অভিযোগ রয়েছে, সুদীপ বসাক ছুটিতে যান কিংবা দেশের বাইরে যান অধীনস্থ কাউকে দায়িত্ব দিয়ে যান না। সব ফাইল, নথিপত্র ও ভাউচারে অগ্রিম স্বাক্ষর করে তবেই যান তিনি।

জানা যায়, ২০০৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের সাগরিকা জহুর আহমেদ স্টেডিয়ামের এলাকায় তেল চুরির সময়ে ৫০০ লিটার অকটেনসহ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের দুই চালক ও পুল কর্মকর্তা জয়সেন বড়ুয়াকে যৌথবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেন মনিরুল ইসলাম নামে সেখানকার এক কর্মচারী। ওই সময় জয়সেন বড়ুয়ার বাসায় তল্লাশি চালিয়ে ৪৭ লাখ টাকার প্রাইজবন্ডসহ কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় জয়সেন বড়ুয়া জেলও খাটেন প্রায় ১৮ মাস। ২০১০ সালের ৯ অক্টোবর মনিরুল ইসলামকে অপহরণের অভিযোগ জয়সেন বড়ুয়াসহ তিনজনের বিরুদ্ধে নগরের পাহাড়তলী থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন মনিরুল ইসলামের মা। এরপর উল্টো চাকরি চলে যায় চুরি ধরিয়ে দেওয়া মনিরুল ইসলামের।

জানতে চাইলে মনিরুল ইসলাম বলেন, ২০০৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি জহুর আহমেদ স্টেডিয়াম এলাকায় ৫০০ লিটার তেল চুরি ধরে দিয়ে আজ আমি চাকরিচ্যুত হয়েছি। দেশের স্বার্থ চিন্তা করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সব সময় প্রতিবাদ করি আসছি। সাম্প্রতিক সময়ে দুদকে অভিযোগও দিয়েছি। সিটি মেয়র মহোদয়কে বিষয়টি জানানোর উদ্যোগ নিলে অভিযুক্তদের বড় তদবির আমাকে থামিয়ে দেয়।

বিষয়টি স্বীকার করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাহী প্রকৌশলী জয়সেন বড়ুয়া বলেন, ‘ওনার (সুদীপ বসাক) স্বাক্ষরে করপোরেশনের সমস্ত গাড়ির অকটেনসহ যান্ত্রিক বিভাগ ও বেশ কয়েকটি বিভাগের কাজ চলে। উনি তিনদিনের জন্য ঢাকায় ট্রেনিংয়ে আছেন। তাই খালি ভাউচার বইয়ে স্লিপে তিনি স্বাক্ষর করেছেন।’

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের যান্ত্রিক বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সুদীপ বসাকের মুঠোফোনে একাধিকবার তার ফোন করা হলেও সেখান থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সামসুদ্দোহা বলেন, ‘চসিকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সুদীপ বসাক তিনদিন ধরে ট্রেনিংয়ে ঢাকায়। তার অনুপস্থিতিতে তার স্থলে সম্ভবত জয়সেন বড়ুয়া কাজ করে। তার (সুদীপ বসাক) অগ্রিম ভাউচার বইয়ের স্বাক্ষর করা স্লিপে তেল বিলির বিষয়টি জানা নেই। এই ধরনের কাজ করা তো ঠিক না। বিষয়টি খতিয়ে দেখবো।’

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ১৪ অক্টোবর দুর্নীতি দমন কমিশন জেলা সমন্বিত কার্যালয় চট্টগ্রাম-১ এর গণশুনানিতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তেল চুরির ঘটনার অনেক অভিযোগ উঠে।

এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!