আওয়ামী লীগের গৃহবিবাদ রুখতে হবে ক্ষমতায় নয় মমতায়

মন্তব্য প্রতিবেদন

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আসন্ন নির্বাচনে মেয়র নয়, মূলতই কাউন্সিলরদের মধ্যে লড়াইটা আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের। স্বাধীনতার ৪৮ বছরের মধ্যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল না বেশি সময়। ক্ষমতার ২১ বছরের মধ্যে টানা ১১ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকার মাসুল গুণতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে— এবারের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে। চট্টগ্রাম শহরের এখন আওয়ামী লীগের তেমন কোন শক্তিশালী প্রতিপক্ষ মাঠে নেই বললেই চলে।

দীঘদিনের ক্ষমতাহারা বিএনপি ক্রমশ শক্তিহারা হয়ে পড়ছে। ৪১টি ওয়ার্ডে বিএনপির তেমন কোন বিদ্রোহী প্রার্থী নেই। বিদ্রোহী প্রার্থী তো দূরের, জনপ্রিয় ৪১ কাউন্সিলর প্রার্থীর খোঁজ পেতেই কষ্ট হয়েছে দলটির। বলা যায় বিএনপি মাঠে নেই, নেই প্রধান বিরোধী দলেও। এমনকি বিএনপিপন্থী ‘সুশীল সম্প্রদায়’ও অনেকটাই লেজ গুটিয়ে রয়েছে। তাদের কেউ প্রকাশ্যে আসছে না জনকল্যাণমুখী এজেন্ডা নিয়ে। তবে সেই সুযোগও পাচ্ছে না তারা। কারণ নাগরিক সমস্যা হোক কিংবা অন্য কিছু হোক— কোনো ইস্যুতেই তাদের নামার সুযোগ রাখছে না আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের কোন শক্তিশালী প্রতিপক্ষ না থাকায় আওয়ামী লীগ এখন নিজেরাই কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে লড়ছে এবারের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে।

৪১ ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ মনোনীত ৪১ কাউন্সিলর প্রার্থীর বিপরীতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা অন্তত পাঁচ গুণ। এর মধ্যে বর্তমান কাউন্সিলর রয়েছে অন্তত ১৩ জন। সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর ১৪ জনের বিপরীতে বিদ্রোহী প্রার্থী একাধিক। বিদ্রোহীদের মধ্যে বর্তমান কাউন্সিলর রয়েছে ৮ জন। ৪১ ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ মনোনীত ৪১ প্রার্থী ছাড়া আওয়ামী লীগের সমর্থন না পাওয়া প্রার্থীরা নিজেদেরকে ‘বিদ্রোহী’ অ্যাখায়িত করাটা কোনভাবেই মেনে নিচ্ছেন না।

তারা বলছেন, এরশাদবিরোধী আন্দোলন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অপশাসনবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে গণতান্ত্রিক সব আন্দোলন সংগ্রামে তাদের অনেকে জেল-জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কিন্তু তাদেরকে মনোনয়ন না দিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত নেই— এমন অনেকেই মনোনয়ন পেয়েছে এবার। তারা বলছেন, দলীয় প্রধান কিংবা মনোনয়ন বোর্ডকে ভুল ধারণা কিংবা ভুল তথ্য দিয়েই অনেক ওয়ার্ডে মনোনয়ন নিয়েছে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নেই এমন ব্যক্তি, বিএনপির সঙ্গে পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট কিংবা অজনপ্রিয় লোকজন।

চট্টগ্রামের স্থানীয় পর্যায়ের এই বিরোধকে ভালো দৃষ্টিতে দেখছেন না আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা। তারা মনে করেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে সব ধরনের আন্দোলনে চট্টগ্রামের ভূমিকা অনন্য। ঢাকার পরই রাজনীতিতে চট্টগ্রামের অবস্থান। কিন্তু চট্টগ্রামের স্থানীয় পর্যায়ের এই বিরোধ কিংবা অন্তর্কোন্দলের বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়তে পারে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া সর্বত্রই। স্থানীয় পর্যায়ের এই বিরোধ নিজেদের ঘরেই সীমাবদ্ধ নেই। দেশের গণমাধ্যমগুলোর বরাতে এর খবর ছড়িয়ে পড়ছে দেশজুড়ে। প্রিন্ট কিংবা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ফলাও করেই প্রচার করছে চসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থীদের বিবাদ। অন্যপক্ষকে দুষছেন কিংবা গালি দিচ্ছেন— গণমাধ্যমে এসব খবর প্রকাশিত হচ্ছে প্রতিদিনই।

সর্বশেষ দেখা গেল, কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছে চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীদের সাথে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের বৈঠক। রোববার (৮ মার্চ) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের চট্টগ্রাম এসে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন বলে ওই বৈঠকে জানানো হয়। ৫ মার্চ সকাল ১১টায় চট্টগ্রাম থিয়েটার ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীদের সাথে আওয়ামী লীগের এই বৈঠক শুরু হয়। চসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রধান সমন্বয়ক ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এই সভায় উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে তিনি কাউন্সিলর পদে দলের একক প্রার্থী রেখে বিদ্রোহীদের নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেও বিদ্রোহী কাউন্সিলররা নির্বাচনে থাকার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। তারা সবাই নৌকার নির্বাচন করবেন জানিয়ে কাউন্সিলর পদে নির্বাচন উন্মুক্ত করে দেওয়ার দাবি জানান।

সভায় দলীয় মনোনয়ন নিয়ে বিদ্রোহীরা তাদের অভিযোগ তুলে ধরলে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ জবাবে বলেন, ‘সবাই সবার বিরুদ্ধে কথা বলতে পারেন। সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে মনোনয়ন বোর্ড যাদের সমর্থন দিয়েছে তাদের জন্য কাজ করতে হবে।’ এর জবাবে বিদ্রোহীরা সমস্বরে ‘না না’ বলে উঠলে মোশাররফ বলেন, ‘তাহলে ৮ তারিখ কাদের ভাই আসবেন। উনিই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন।’

কিন্তু তাও হচ্ছে না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রোববার (৮ মার্চ) চট্টগ্রাম আসলেও বসবেন না বিদ্রোহীদের সঙ্গে। তিনি বসবেন নগর আওয়ামী লীগ কিংবা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে। এ নিয়ে হতাশ বিদ্রোহীরা। তারাও অনঢ় তাদের সিদ্ধান্তে— নির্বাচন করবেন।

চসিক নির্বাচনকে সামনে রেখেই আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থীরা যেভাবে একে অপরকে দোষারোপ ও কথার আক্রমণ হানছেন কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমজুড়ে যেভাবে চলছে বাকযুদ্ধ— তা আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য অশনি সংকেত। মাঠে কাজ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন। তৎপরতা বাড়ছে গোয়েন্দাদেরও। বিভাজন হচ্ছে ওয়ার্ড পর্যায়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি। জন্মাচ্ছে নতুন নতুন গ্রুপ-উপ গ্রুপের। এসবের ফলে বিভ্রান্তিতে পড়ে গেছেন আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকরাই।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল বলছে, গত ৫ বছরে নির্বাচনের ব্যাপারে ভোটারদের আগ্রহ যেন কমছে দিন দিন। ঢাকা সিটি নির্বাচনের পুরোই উল্টো চিত্র চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের এবারের নির্বাচনে। মেয়র পদে দলীয় সিদ্ধান্তকে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা মনেপ্রাণে না মানলেও কেউ কেউ মাঠে কাজ করবেন দলীয় পদ হারানোর শংকায়। তবে বিদ্রোহীদের বশে আনতে না পারলে মনোনীত কাউন্সিলরদের নির্বাচিত করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ লক্ষ্যচ্যূত হতে পারে। এতে সুবিধাজনক অবস্থান নেবে বিএনপির জনপ্রিয় প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের কোন্দলে সুযোগসন্ধানী বিএনপি কাউন্সিলর প্রাথীদের একেবারেই দুর্বল ভাবাটা ঠিক হবে না মোটেই। সংঘাতের শংকায় ভোটার উপস্থিতিও কমতে পারে। বাড়তে পারে মাঠপর্যায়ে গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতাও।

তবে আওয়ামী লীগের করণীয় হবে বিদ্রোহীদের সঙ্গে দফারফা করেই মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করানো। সভা-সমাবেশ কিংবা ঘরোয়া বৈঠকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা যেভাবে বিদ্রোহীদের সরে যাওয়া নির্দেশ দিচ্ছেন, তাও কিন্তু সঠিক পথ নয়। কারণ বিদ্রোহীদের অনেকেই দলের ত্যাগী ও আন্দোলন-সংগ্রামে জেল জুলুম নির্যাতনে শিকার হয়ে কারাভোগও করেছেন। এদের ত্যাগকে অস্বীকারও করতে পারবে না আওয়ামী লীগ। এতো সব নেতাকে বহিস্কার করাও শুভ হবে না কোন রাজনৈতিক দলের জন্য। বিদ্রোহ রুখতে হবে ক্ষমতায় নয় মমতায়। না হয়, ইমেজ সংকটে পড়তে হবে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!