আওয়ামী লীগের কমিটি নিয়ে চট্টগ্রাম উত্তর থেকেই বেশি আপত্তি গেছে কেন্দ্রে

গত সেপ্টেম্বর ছিল জেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটির নাম প্রস্তাব করার শেষ দিন। এই সময়ের মধ্যে প্রস্তাবিত পূর্ণাঙ্গ কমিটির নাম এসেছে ৩১ জেলা থেকে। কিন্তু প্রস্তাবিত এসব কমিটির বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে শতাধিক। কমিটির ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি আপত্তি এসেছে যে তিন জেলা থেকে— সেগুলো হচ্ছে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা, সিলেট এবং ঠাকুরগাঁও।

জানা গেছে, গত ২ অক্টোবর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে এসব অভিযোগ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এই কমিটিগুলো যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ৮ বিভাগে আলাদা করে উপকমিটি করেও দিয়েছেন। প্রেসিডিয়াম সদস্যদের নেতৃত্বে এই উপকমিটি নামগুলো খতিয়ে দেখবে। এরপর তারা সুপারিশ করবে আওয়ামী লীগ সভাপতিকে।

জানা গেছে, যে ৩১টি জেলা থেকে কমিটির প্রস্তাব এসেছে, তার সবগুলো থেকেই অভিযোগ ও আপত্তি এসেছে। অনেক জেলা থেকে এসেছে একাধিক অভিযোগ। কোনো কোনো জেলা থেকে গণস্বাক্ষর করে আপত্তি জানানো হয়েছে জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পাঠানো কমিটির ব্যাপারে।

আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, জেলা কমিটির ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি আপত্তি এসেছে যে তিন জেলা থেকে— সেগুলো হচ্ছে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা, সিলেট এবং ঠাকুরগাঁও। আওয়ামী লীগের ঐতিহ্য অনুযায়ী, একটি জেলায় সম্মেলনের পরপরই সেখানে সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হয়। সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক বসে একটি পূর্ণাঙ্গ জেলা কমিটির নাম প্রস্তাব করে কেন্দ্রে পাঠায়। কেন্দ্র এই কমিটি অনুমোদন দেয়।

দলীয় সূত্রগুলো বলছে, এই জেলা কমিটিগুলো এক ‘দুষ্টচক্রে’ বন্দি। এলাকার এমপি বা প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতা তার পছন্দের ব্যক্তিকে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করেন। এরপর নিজস্ব লোকজন দিয়ে একটি কমিটি করেন। এটি হয় এমপি বা প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতার পকেট কমিটি। অনুগত জোগাড় করতে গিয়ে এমনকি বিতর্কিত ও অনুপ্রবেশকারীরাও জায়গা পায় দলে।

দলীয় সূত্র জানাচ্ছে, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এরকম ‘মাইম্যান’ কমিটি গঠনের বিরুদ্ধে এবার অবস্থান নিয়েছেন। একই সাথে তিনি যে সাত হাজার অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করেছেন, তারা যেন কোন কমিটিতে না থাকে তা নিশ্চিত করার নির্দেশনা দিয়েছেন।

জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারিতে কেন্দ্রে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটির তালিকা যাওয়ার পর নানা মহলে দেখা দেয় ক্ষোভ। প্রস্তাবিত ওই কমিটি নিয়ে ব্যাপক ‘অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা’র অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে অভিযোগ দেওয়া হয় দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছেও।

গত বছরের ৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এমএ সালামকে সভাপতি ও মিরসরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি শেখ আতাউর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করেন কাউন্সিলররা।

জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারিতে নবনির্বাচিত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ৭৫ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা কেন্দ্রে জমা দেন। সেই কমিটিতে মোট ১১ জন সহ সভাপতি, ৩ জন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাখা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে এক নম্বর সিনিয়র সহ সভাপতি হিসেবে রয়েছেন হাটহাজারীর অধ্যাপক মঈনুদ্দিন। সহ-সভাপতি পদে ২ জনের মধ্যে আবুল কালাম আজাদ ও রাউজান উপজেলা চেয়ারম্যান চেয়ারম্যান এহছানুল হায়দার চৌধুরী বাবুল, রাঙ্গুনিয়া থেকে ২ জন, ফটিকছড়ি উপজেলা থেকে ২ জন, সীতাকুন্ড থেকে একজন, মীরসরাই থেকে ২ জন এবং সন্দ্বীপ থেকে একজনকে রাখা হয়। এছাড়া তিনজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের তালিকায় মিরসরাইয়ের নুরুল আনোয়ার চৌধুরী বাহার, দেবাশীষ পালিত ও জসীম উদ্দিন শাহ এবং তিনজন সাংগঠনিক সম্পাদকের মধ্যে খাদিজাতুল আনোয়ার সনি এমপিসহ বেশ কয়েকজনের নামও রয়েছে।

কমিটি নিয়ে নানা অভিযোগ উঠার পর গত ১১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ ভবনে সংসদ নেতার কার্যালয়ে সংসদ নেতা ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর সঙ্গে দেখা করেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের ৮ নেতা। এ সময় কমিটি গঠনে ব্যাপক অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও আত্মীয়করণের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অভিযোগ জানান তারা। নেতারা অভিযোগ করে দলীয় সভানেত্রীকে জানান, শুধুমাত্র ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা ও ক্ষোভ উদ্ধারে ‘সবচেয়ে পরীক্ষিত ও ত্যাগী’ নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে নতুন কমিটি করা হয়েছে। তাছাড়া রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা না থাকার পরও নেতাদের ব্যাবসায়িক পার্টনার, কর্মচারী, আত্মীয়সহ নানা বিবেচনায় অনেককে কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদেও রাখার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তারা।

জানা গেছে, দীর্ঘক্ষণ ধরে চলা এই সাক্ষাতে এই প্রতিনিধিদলের অভিযোগগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি কমিটি গঠনে সংশ্লিষ্ট নেতাদের ভূমিকার বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন। এসব অভিযোগ গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করেছেন ওই ৮ নেতাকে।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে অংশ নেওয়া নেতারা হলেন নুরুল হুদা, গিয়াস উদ্দিন, রাউজান উপজেলা চেয়ারম্যান এহসানুল হায়দার চৌধুরী বাবুল, ইউনুছ গনি চৌধুরী, তৌহিদুল আলম বাবু, এসএম আবু তৈয়ব, শাহনেওয়াজ চৌধুরী এবং এসএম বাকের।

এ বৈঠকের পর চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ সভাপতি গিয়াস উদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, ‘আমরা নেত্রীকে আমাদের অভিযোগ জানিয়েছি। অতীতে মোশাররফ ভাই কমিটি করে পাঠালে সাথে সাথে অনুমোদন হয়ে যেতো। এবারই প্রথম প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় কমিটির অনুমোদন আটকে গেল। বিষয়টি নেত্রী গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন বলে এমনটি হয়েছে। এটাই আমাদের অর্জন ও প্রাপ্তি।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!