আউটার রিং যেন চট্টগ্রামের এক অভিশপ্ত সড়ক, দুর্ঘটনা একের পর এক

পরিবারের আট সদস্যদের দায়িত্ব আরিফের কাঁধের ওপর। পিকআপ চালিয়ে সংসার চালাতেন ২২ বছরের যুবক মো. আরিফ। একটি সড়ক দুর্ঘটনাই বদলে দেয় তার জীবন। গত ২৪ এপ্রিল রোজার মাসে চট্টগ্রাম নগরীর বন্দর থানার আনন্দবাজার এলাকার আউটার রিং রোডে পিকআপ ও ট্রেইলারের মুখোমুখি সংঘর্ষে গুরুতর আহত হয়ে দুটো পা হারাতে বসেছে এই যুবক। আশাহীন স্বপ্ন নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেলের ২৬ নং ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এরপর বাড়ি ফিরলেও আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। করতে পারেন না স্বাভাবিক চলাফেরাও।

শুধু আরিফই নয়, গত কয়েক বছরে আউটার রিং রোডে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন বহু মানুষ। লকডাউনের আগে গত ২৩ জুন দুপুরে এই আউটার রিং রোডে একটি গরুবাহী ট্রাককে দ্রুতগতিতে অতিক্রম করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যায় প্রাইভেট কার। পরদিন ২৪ জুন বিকেলে আউটার রিং রোডে পাথরবাহী ডাম্পারের ধাক্কায় নামের লোটাস আইডিয়াল স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ১২ বছরের হানিফের মৃত্যু হয় ঘটনাস্থলেই।

এর আগে চলতি বছরের ২২ মে সন্ধ্যায় একজন শিশুসহ মুসলিমাবাদ বেড়িবাঁধে নৌবাহিনীর গাড়ির সাথে প্রাইভেট কারের মুখোমুখি সংঘর্ষে গুরুতর আহত হয়ে পরে ৩০ মে চমেক হাসপাতালে মারা যান আব্দুল মাবুদ (৪৫) নামের এক ব্যক্তি। ১৮ মে চরপাড়া বেড়িবাঁধে টমটম ও কারের মুখোমুখি সংঘর্ষে গুরুতর আহত হন এক টমটমচালক। ১০ এপ্রিল বেপজা পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ ছাত্র সজিব উদ্দিন তৌহিদ বাইক দুর্ঘটনায় মারা যান। ৮ মার্চ খেজুরতলায় প্রাইভেট কারের ধাক্কায় দুজন মোটরসাইকেল আরোহীসহ মুসলিমাবাদ বেড়িবাঁধে পতেঙ্গা থানার এক পুলিশ কর্মকর্তার মোটরসাইকেলে সাধারণ পথচারী আহত হন। গত ৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় রিং রোডে গাড়ির ধাক্কায় ৬০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়।

আউটার রিং যেন চট্টগ্রামের এক অভিশপ্ত সড়ক, দুর্ঘটনা একের পর এক 1

ওই এলাকায় বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আনন্দবাজার এলাকার আউটার রিং রোডে দুর্ঘটনার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে— আলোর ব্যবস্থা না থাকা অন্যতম, গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে স্পিডব্রেকার না থাকা, ওভারটেকিং, মোটরবাইকের রেইস, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতার পাশাপাশি চালকদের অন্যমনস্কতা।

সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাগুলোর বেশিরভাগই ঘটেছে বিকেলে ও রাতে। আর এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যানবাহনের মধ্যে ট্রাক-কাভার্ডভ্যান- লরি, প্রাইম মুভার,পিকআপ, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল, সিএনজ ও ইজিবাইকের দৌরাত্ম্য।

ধর্মীয় উৎসবকাল, সরকারি ছুটি ছাড়াও সাপ্তাহিক ছুটির দিনে লোক চলাচল ও গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধির কারণেই সড়ক দুর্ঘটনার প্রবণতা ও ঝুঁকি বেড়ে যায়। সড়কটিতে অবৈধ যানবাহন দাপিয়ে বেড়ালেও দেখার যেন কেউ নেই।

স্থানীয় এলাকাবাসী ও পথচারীরা সিডিএ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর চরম উদাসীনতাকেই দায়ী করেছেন। তারা বলছেন, গত কয়েক বছরে দৃষ্টিনন্দন (সিডিএ) আউটার রিং রোডটি প্রায় প্রতিদিনই বেপরোয়া গাড়ি চলাচলের কারণে একের পর এক বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনায় প্রায়ই রক্তাক্ত হচ্ছে। দিন দিন বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা। সড়কটিতে চলছে কন্টেইনার, লরি, প্রাইম মুভার, কাভার্ড ভ্যান, ট্রাক, মিনি ট্রাক, বাস, প্রাইভেট কার, সিএনজি, অবৈধ টমটমসহ শত শত গাড়ি। বিদ্যুৎবিহীন রাতের অন্ধকারে গুরুত্বপূর্ণ সড়কটি যেন দিন দিন যেন ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করছে। গত এক বছরের মধ্যে একাধিক সড়ক দুর্ঘটনায় সেখানে নিহত ও আহতের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।

জানা যায়, নগরীর পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত সিডিএ ও জাইকার যৌথ অর্থায়নে নির্মিত সিটি আউটার রিং রোড নির্মাণ প্রকল্প। পতেঙ্গা থেকে সাগরিকা পর্যন্ত ১৫.২ কিলোমিটার দীর্ঘ ৮৪ ফুট প্রস্থ ৩০ ফুট উঁচু এ সড়কটিতে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকায় চার লেনের সড়কটির কাজ শুরু করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।

পতেঙ্গা মুসলিমাবাদ এলাকার বাসিন্দা নেজাম উদ্দিন জানান, বিদ্যুৎবিহীন আউটার রিং রোডে একের পর এক ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। ঝড়োগতিতে গাড়ি চালানো, মোটরসাইকেল ও কার রেইসের পাশাপাশি চালক ও পথচারীদের অসাবধানতার বিষয়গুলোসহ সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের নজরদারি খুবই জরুরি।

উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক-পশ্চিম) তারেক আহমদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, সিডিএ আউটার রিং রোডে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে (ট্রাফিক-বন্দর) ও (ট্রাফিক-পশ্চিম) যৌথ উদ্যোগে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। প্রয়োজনে মাঝে মাঝে ক্রাইম বিভাগও আমাদের সাথে কাজ করে। সড়কে অবৈধ টমটম জব্দ করার পাশাপাশি ফাঁকা সড়কে দ্রুতগতিতে মোটরবাইক রেইস প্রতিযোগিতা, প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাসসহ আইন অমান্যকারী বিভিন্ন যানবাহনের ওপর মামলা করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

তিনি বলেন, অন্ধকারে কিংবা গভীর রাতে সড়কে চালকেরা সতর্কতা অবলম্বন না করে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। ট্রাফিক বিভাগের দায়িত্বে থাকা কর্মীদের অফিস শেষে যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে তখন আমাদের কিছু করার থাকে না। তবে সড়কে বিদ্যুতের সংযোগ ও আলোর ব্যবস্থা খুবই জরুরি বলে তিনি মনে করেন।

এদিকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, মূল সড়কে কোনো ধরনের বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই। আমাদের জাংশন পয়েন্ট আর পতেঙ্গা বিচ পয়েন্টে বিদ্যুৎ থাকবে। যেহেতু সেটা হাইওয়ে রোড টানেলের সাথে যুক্ত হবে, সেহেতু বিদ্যুতের ব্যবস্থা থাকবে না। জংশন আর ক্রসপয়েন্টে কিছু লাইট আর পতেঙ্গা পয়েন্টে লাইট থাকবে।

সংযোগ সড়কগুলো দিয়ে গাড়ি চলাচলের কারণে সম্প্রতি একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে— এমন তথ্যের জবাবে তিনি বলেন, এই সংযোগ সড়ক দিয়ে গাড়ি চলাচলের কোনো ধরনের এক্সেস আমরা দেইনি, আর দেবও না। ওই ইন্টারনাল রোড দিয়ে গাড়ি ওঠার কোনো ব্যবস্থাও আমরা রাখিনি। এগুলো সিটি করপোরেশন করছে। তারা মাটি ফিলিং করে উঠছে। বিভাজক (ডিভাইডার) স্থাপনের পরও সংযোগ সড়ক থেকে যানবাহন রিং রোডে ওঠার প্রবণতা দুর্ঘটনা বাড়িয়ে দিচ্ছে— এটা তো মারাত্মক ভয়ংকর বিষয়। এটা আমরা সুইচার প্রজেক্টে রাখবো, আমরা সার্ভিসও করবো। সার্ভিস করে সার্ভিস রোডের সাথে মিলিয়ে তারপর ওঠবে উপরে। ইন্টারনাল রোড দিয়ে ওঠার কোন নিয়ম নেই।

প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, হাইওয়ে রোড, সার্ভিস রোডগুলো আমরা সুইচারের প্রজেক্টে করবো। ৪০ ফিটের একটি সার্ভিস রোড থাকবে— ওই সার্ভিস রোডের মাধ্যমে মূল রোডে আসতে হবে। ইপিজেড দিয়েও এ সড়কে চলাচলের ব্যবস্থা থাকবে। পাঁচ হাজার গাড়ির চাপ কমাতে আউটার রিং রোড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

এই পুরো কাজ শেষ হতে আর কত সময় লাগতে পারে— এমন প্রশ্নের জবাবে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী বলেন, ছয় বা এক বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ কাজ শেষ হবে বলে আমরা আশা করছি।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!