আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায় মানুষ পাচারকারীরা

মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২ পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় পাচার বাড়ছে বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা। আলাদা আইন হলেও পৃথক মানবপাচার দমন ট্রাইব্যুনাল গঠন না করা এবং এ সংক্রান্ত কোনো বিধিমালা না করায় দ্রুত নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না এ মামলাগুলো। প্রশ্ন উঠছে মানবপাচার বা অবৈধ অভিবাসী ঠেকাতে দেশে প্রচলিত আইন কতটা কার্যকর।

তবে জানা যায়, মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন-২০১২-এ মানব পাচারের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেও আজ পর্যন্ত কোন অপরাধীর এই সাজায় দণ্ডিত হওয়ার নজির নেই। তিন বছরেও গঠিত হয়নি মানব পাচার দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। এখন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত আইনে ৪ হাজার ৬৬৮টি মামলা হয়েছে। কিন্তু নিষ্পত্তি হয়েছে কেবল মাত্র ২৪৫টি মামলা। এসব কারণে মানবপাচারের হার বেড়েছে বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা।

আইনজীবী ও বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশেনের সভাপতি জিয়া হাবীব আহসান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘রোহিঙ্গারা এদের মূল টার্গেট। যারা মানবপাচার করছে তাদেরকে আইনের আওতায় এনে বিচারকার্য যদি দ্রুতগতিতে করা যায় বা করা হতো— তাহলে আমার মনে হয় মানবপাচার যেভাবে হচ্ছে সেটা বন্ধ হত। অতীতের মামলাগুলোর বিচার না হওয়ায় এবং মানব পাচারের সাথে অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসন ও প্রভাবশালী লোকজন জড়িত থাকায় মামলা হলেও সুবিচার পান না ভুক্তভোগীরা।”

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাষ্ট (ব্লাস্ট) এর নিজস্ব আইনজীবী মিসকাতুত তানজিমা আজিম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাংলাদেশে মানবপাচারের মামলা নিষ্পত্তি বেশ সময়সাপেক্ষ। অন্যান্য আইনে কেসগুলো ফেলা হচ্ছে। সেগুলো হালকাভাবে দেওয়া হয়েছে অথবা তদন্ত ঠিকমতো করা হচ্ছে না। ফাইনাল রিপোর্ট দিয়ে দেওয়া হচ্ছে অথবা ত্রুটিপূর্ণ তদন্ত করা হচ্ছে। যে কারণে শেষ পর্যন্ত কাউকে সাজা দিতে পারছে না। আমার মনে হয়, এ আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিলে কমে আসবে মানবপাচার।’

চলতি বছরের ২০ জুন প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বার্ষিক ‘ট্রাফিকিং ইন পারসনস রিপোর্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে টানা তৃতীয়বারের মতো নজরদারির তালিকায় বাংলাদেশ। ২০১৮ সালের প্রতিবেদন প্রকাশের পর সরকারের প্রচেষ্টা ওই বছরের তুলনায় জোরদার হতে দেখা যায়নি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, মানবপাচার বন্ধে বাংলাদেশ সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ, পাচারকারীদের বিচারের আওতায় আনা, শিশু পাচারের অভিযোগে এক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত এবং রোহিঙ্গা পাচারের অভিযোগে তদন্ত অব্যাহত রাখা। তবে ২০১৮ সালের মানব পাচারবিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশের পর সরকারের প্রচেষ্টা ওই বছরের তুলনায় জোরদার হতে দেখা যায়নি। সরকার মানব পাচারের শিকার ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে পেরেছে খুব কম সংখ্যায় এবং যাদের চিহ্নিত করেছে তাদের মধ্যেও অনেক কমসংখ্যক ব্যক্তিকে সেবা দিতে পেরেছে।

প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অংশে বলা হয়, মানবপাচারের সমস্যা যত প্রকট, সেই তুলনায় তদন্ত ও বিচার যে অপর্যাপ্ত তা স্বীকার করেছে বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা জোরপূর্বক শ্রম ও মানব পাচারের শিকার হচ্ছে বলে বিশ্বাসযোগ্য কমপক্ষে ১০০টি অভিযোগ পাওয়া গেলেও সরকার এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত বা বিচারের কথা জানাতে পারেনি।

প্রতিবেদনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে, বাংলাদেশে মানব পাচারের সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের জড়িয়ে পড়ার মতো ঘটনা এখনো গুরুতর একটি সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। কিন্তু সরকার এ ধরনের অভিযোগের ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানায়নি। শুধু তা-ই নয়, বিদেশে কর্মী নেওয়ার অবৈধ এজেন্টদের চিহ্নিত করতেও সেভাবে পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বাংলাদেশে।

প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে আরও বলা হয়, আন্তর্জাতিক একটি সংগঠনের তথ্যমতে, প্রতি বছর সাত লাখের বেশি বাংলাদেশি অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমায়। তাদের প্রায় সবাই মানব পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ার ঝুঁকিতে থাকে।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এর আগে থেকেই বাংলাদেশে আশ্রিত ছিল আরও চার লাখের মতো রোহিঙ্গা। বর্তমানে সব মিলিয়ে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজার জেলার উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে বসবাস করছে ।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!