অশ্রুঝরা দিনে ১৮ বুলেটে রক্তস্নাত বাংলাদেশ

বেদনাবিধুর ১৫ আগস্ট এক কলঙ্কিত দিন। সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যার রক্তস্নাত দিন। বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ পুরুষ তিনি। অতুলনীয় নেতৃত্বে পরাধীন জাতিকে মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলেন অসীম প্রেরণার উৎস হয়ে। মানুুষের প্রতি যার ছিল অসীম মমত্ববোধ, সেই মানুষটিকেই নির্মমভাবে বিদ্ধ হতে হয়েছিল ১৮টি বুলেটে। যে তিনি সদ্য স্বাধীন দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সংবিধান প্রণয়নের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই তিনিই স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকারটুকু পাননি।

এই দেশ আর দেশের মানুষের মুক্তির জন্য মাত্র ৫৫ বছরের জীবনের অনেকটাই কেটেছিল তার পাকিস্তানি শাসকদের কারান্তরালে। স্বাধীনতার স্থপতি সেই অবিসংবাদিত নেতা স্থাধীন বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পচাত্তরের এই দিনে সুবেহ সাদেকের সময় নিহত হন। মৌলবাদী স্বাধীনতাবিরোধী চক্র আর সাম্রাজাবাদের এদেশীয় দোসরদের যৌথ চক্রান্তে নিহত হন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে খ্যাত মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।

বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য, একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শোষণহীন সমাজ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যিনি জীবনের সর্বস্ব বাজি রেখে নিরন্তর সংগ্রাম করে গেছেন, যার নেতৃত্বের সম্মোহনী শক্তিতে বাংলার মানুষ ১৯৭০-৭১ সালে অতুলনীয় একর প্রাচীর গড়ে তুলেছিল পাকিস্তানি সামরিক-সাম্প্রদায়িক দুঃশাসনের বিরুদ্ধে, জার্মান রূপকথার হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো যিনি তার উদাত্ত আহ্বানে সম্মোহিত করেছিলেন সমগ্র জাতিকে— সেই উদারপ্রাণ দেশপ্রেমিক মহান নেতাকে তারই স্বপ্নের স্বাধীন রাষ্ট্রে কেউ হত্যা করতে পারে তা ছিল তাঁর কাছেই কল্পনার অতীত।

সেই অকল্পনীয় ঘটনাই সারা পৃথিবী প্রত্যক্ষ করল বিস্মিত হয়ে। মীরজাফরের প্রেতাত্মারাও যে কালে কালে বাংলায় আবির্ভূত হয়, তারই কলঙ্কিত দৃষ্টান্ত ১৫ আগষ্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ড। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী-পুত্র-পুত্রবধূ, আত্মীয়-পরিজন এমনকি তার শিশুপুত্র রাসেলসহ একাধিক শিশুকেও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল সেই রাতে। সেই কালরাত্রির নৃশংসতা ইতিহাসের জঘন্যতম ঘটনামাত্র নয়, মুক্তিযুদ্ধজয়ী এই জাতির গৌরবোজ্জ্বল ললাটে একটি কলঙ্কতিলকও বটে। কারণ. বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামী নেতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এমন এক বাঙালি— যিনি সারাবিশ্বের মুক্তিকামী মানুষেরও অনুপ্রেরণার উৎস।

পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র-কাঠামোয় যে শোষণ-বঞ্চনা আর গণতন্ত্রের স্থলে সামরিকতন্ত্রের আধিপত্য ছিল, তা থেকে তিনি বাংলাদেশ নামের এই ভূখণ্ডকে মুক্তই শুধু করেননি— একটি শোষণমুক্ত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবেও সদা স্বাধীন রাষ্ট্রটিকে সাংবিধানিকভাবে দিয়েছিলেন শক্ত ভিত্তি। ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, তা বঙ্গবন্ধু যথার্থই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি করেছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতা।

গণতন্ত্রের ধর্মই হচ্ছে এই যে, সে কারও মানবাধিকারকে খর্ব করে না। ধনী-গরিব ও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ সবার জন্য রাষ্ট্র হচ্ছে সমান অধিকার ভোগের ক্ষেত্র— ধর্মভিত্তিক রাজনীতি যাকে ক্ষুণ্ন করে, খর্ব করে। তাই বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানি কারাগার থেকে ঢাকায় ফিরে এসে রেসকোর্স ময়দানে বলেছিলেন, ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তিবিশেষ কোনো ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।

এ দেশের কৃষক-শ্রমিক- হিন্দু-মুসলমান সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে— বঙ্গবন্ধু এই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য যখন দিনরাত কাজ করছেন, যুদ্ধবিধবস্ত দেশকে গড়ে তুলতে সংগ্রাম করছেন, বিশ্ববাসীর স্বীকৃতি আদায় করছেন, জাতিসংঘ-ওআইসিসহ নানা ফোরামে স্থান করে নিচ্ছে বাংলাদেশ, দারিদ্র্য আর ক্ষুধা থেকে দেশ বাঁচাতে সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছেন— ঠিক সেই মুহূর্তে স্বাধীনতাবিরোধী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রের যোগসাজশে তাকে হত্যা করা হলো।

বাংলাদেশকে পাকিস্তানি আদলে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে অসাম্প্রদায়িক সংবিধানকে সাম্প্রদায়িক করা হলো। আজ স্বাধীনতার ৫০ বছরের প্রান্তেও জাতিকে যার মাশুল দিতে হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর মতো মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী মানবদরদি দেশপ্রেমিকের মৃত্যু নেই। তাই বাংলাদেশ প্রগতির লড়াই করবে তার আদর্শ নিয়েই।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!