অরণ্যের গহীনে সবুজে অবগাহন

ঘোরাঘুরি যে সবসময় প্ল্যানমাফিক হয়— তা নয়। এবারের ঘোরাঘুরিটাও ছিল তেমন। একদমই পরিকল্পনামাফিক হয়নি। প্রথমে কথা ছিল সেন্টমার্টিন যাবার। সেখানে সমুদ্রের নীল জলে অবগাহন আর ভরা পূর্ণিমার রাতে হবে জ্যোৎস্নাবিলাস। কিন্তু বাধ সাধলেন আমার আত্মীয় উল্লাস দা। বললেন, ‘সেন্টমার্টিন না হয় অন্য কখনও যাবে। শীতের মৌসুম চলছে। পর্যটকদের ভিড় থাকবে বেশি । আমি তো বান্দরবান আছি। চলো রেমাক্রি থেকে ঘুরে আসি।’ রেমাক্রি যেতে বাসে করে প্রথমে পাহাড়ি পথে যেতে হয থানচি। এরপর পাহাড়ি ছড়ায় নৌকায় ভেসে পাড়ি দিতে হবে তিন থেকে চার ঘণ্টার পথ। আহা ভাবতেই কেমন যেন পুলকিত হলাম! ওনার প্রস্তাবটা তাই আমাদেরও মনে ধরলো বেশ। তাছাড়া অনেকদিন ধরেই তিনি বলছিলেন বান্দরবান বেড়াতে যেতে। কী আর করা! আমি ও আমার স্ত্রী তৃণার গন্তব্য তাই ঠিক হলো বান্দরবান।

অরণ্যের গহীনে সবুজে অবগাহন 1

পাহাড়-পর্বত, ঝর্ণা ধারা, নদী, হ্রদ আর অরণ্য নিয়ে বান্দরবান। সবুজ শ্যামল স্নিগ্ধ লাবণ্য তো আছেই। এখানকার সৌন্দর্য তাই অষ্টাদশী কন্যার মতো মনকে আকর্ষণ করে সহজেই। সে আহবানে সাড়া না দিয়ে থাকা যায় না। আমার মতো ভ্রমণপিয়াসী হলে তো আর কথাই নেই! ‘পাহাড়ের ডাক ভাই/ বান্দরবান যাই তাই’— শ্লোগানে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে বাড়ি থেকে সকালেই বেরিয়ে পড়লাম দুজন। গাড়ি নিয়ে পথে খানিকটা ঝামেলায় পড়ে বান্দরবান শহরে পৌঁছাতে প্রায় দুপুর হয়ে গেল। শান্ত এই পাহাড়ি ছোট্ট শহরটায় এবারই যে আমরা প্রথম এসেছি তা নয়। আগেও দুবার করে আসা হয়েছে দুজনের। তবে আলাদাভাবে। এবারই এলাম একসাথে। তাই এবারের ভ্রমণটা একটু অন্যরকম।

উল্লাস দা’র বাসায় উঠতেই এতক্ষণ পেটে পুষে রাখা ক্ষুধার আগুনে কে যেন ঘি ঢেলে দিল। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে খাবার খেতে বেরিয়ে পড়লাম সবাই। দাদা আমাদের নিয়ে গেলেন বান্দরবান শহরের সুপরিচিত ‘শৈ’ রেস্টুরেন্টে। আইটেম ছিল আধসেদ্ধ তোজার সাথে ঝাল নাপ্পি, গোটা কাঁকড়া ভুনা, সাঙ্গু নদীর কাচকি মাছ, গাঢ় মসুর ডাল, চিনিগুঁড়া চালের ভাত। স্বাদে অতুলনীয়! আতিথেয়তার জন্য দাদাকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারলাম না।

অরণ্যের গহীনে সবুজে অবগাহন 2

সাঙ্গু নদী বয়ে গেছে শহরের পাশ দিয়ে। শহরের প্রান্তে থাকা মানুষের কাছে এ নদী আশীর্বাদের মতো। পানীয় জল ও গৃহস্থালির কাজে সাঙ্গুই তাদের নিত্যদিনের চাহিদা মেটায়। দুপুরের খাবারের পর পথের সব ক্লান্তি যেন এক হলো। বিছানায় একটু এলিয়ে নিতে পারলে শরীরটা বাঁচে। কিন্তু দাদা বললেন, ‘ঘুমিয়ে আর কাজ নেই। চলো নদীর পাড় থেকে ঘুরে আসি। এখানে সাঙ্গু অনেক সুন্দর।’ বললাম, ‘চলেন তাহলে, নদীর পাড় থেকে একটু গায়ে হাওয়া লাগিয়েই আসি।’ লতাগুল্ম, গাছগাছালিতে ভরা উঁচু নিচু সবুজ পাহাড়। এর ফাঁকে ফাঁকে মানুষের বসতি। আর নিচ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া সাঙ্গু। শান্ত মেয়ের মতো চুপচাপ। সূর্যের আলোর ঝিলিক উঠা জলে তার ছোট ছোট ঢেউ। আর সে জলে ভাসছে কাঠের নৌকা। নয়নাভিরাম এই রূপ দেখে সব ক্লান্তি যেন নিমিষেই দূর হয়ে গেল। শীতে এ নদীতে পানিপ্রবাহ থাকে কম। তখন দু’ধারে পড়ে সাদা বালুচর। কিছু আদিবাসী শিশুকে দেখলাম বালুচরে খেলছে। দূরে নদীর জলে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটছে আরও কিছু শিশু। ক্রমাগত তারা সাঁতার কেটেই যাচ্ছে। তবে নদীর গভীরে যাচ্ছে না। দেখলাম স্নান সেরে নদী থেকে জল নিয়ে ফিরছে কয়েকজন আদিবাসী মেয়ে। শান্ত সাঙ্গুর কোমল রূপও পাল্টায় সময়ের সাথে। উল্লাস দা বললেন, বর্ষায় পাহাড়ি বন্যার জল না কি নদীর দু’ধারে উপচে পড়ে।

শহরের বালাঘাটায় সুউচ্চ পাহাড় চূড়ায় আছে বুদ্ধ ধাতু জাদি বান্দরবান স্বর্ণমন্দির। সাঙ্গুর পাড় থেকে গেলাম সেখানে। স্থাপত্যশৈলীর বিচারে খুবই দৃষ্টিনন্দন এই মন্দির। মন্দিরের গায়ে বাহারি কারুকাজ। আর তাতে সোনালি রঙের ছোঁয়া। গৌতম বুদ্ধের নানা রূপে সজ্জিত মূর্তি ও রেলিংয়ের ম্যূরাল নান্দনিক শিল্পকর্মেরই বহিঃপ্রকাশ। আশপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ এখানকার সৌন্দর্যকে করেছে আরো আকর্ষণীয়। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য আর শিল্পের মাধুর্য্যে এ যেন এক মনোরম দৃশ্য। সত্যিই অসাধারণ!

অরণ্যের গহীনে সবুজে অবগাহন 3

শেষ বিকেলে উল্লাস দা আমাদের নিয়ে গেলেন কাছের পর্যটন স্থান নীলাচলে। প্রকৃতির সাথে কৃত্রিমতার মিশেলে অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি এটি। পাহাড়ের ঢালে ঢালে আছে নানা অয়োজন— ঝুলন্ত নীলা, নীহারিকা, ভ্যালেন্টাইন্স পয়েন্ট। এক একটি স্থান যেন প্রকৃতিকে উপভোগের সরস কবিতা। এখান থেকে পাখির চোখে দেখতে পেলাম পাহাড়বেষ্টিত বান্দরবান শহর। আমাদের কপাল ভালো। তাই নীলাচলের চূড়া থেকেই উপভোগ করলাম সূর্যাস্ত। সূর্য ডোবার সাথে সাথে সন্ধ্যা নামতে আর সময় নিল না। আবারও ফিরে এলাম শহরে। মনে মনে ভাবলাম পাহাড়ি খাবারে ভূরিভোজ না হলে কি হয়! সন্ধ্যার স্ন্যাকস খেলাম বমঃ ডং ফাস্ট ফুড হাউজে। এটা নাকি স্থানীয় খাবারের সবচেয়ে পুরনো দোকান। ছিল চিকেন চাটনি, নুডলসের তৈরি মুন্ডি, ডিম চাটনি, কাঁকড়া ভাজা, পাহাড়ি ডাল লুচি। রাতে বসলাম পরদিনের ট্যুর প্ল্যান নিয়ে। কিন্তু বিধি বাম! রেমাক্রি গেলে আরো সঙ্গী নিতে হবে, সময় লাগবে বেশি। সে তুলনায় বগালেক যাওয়া সহজ। আর যাওয়ার পথে রুমাও ঘোরা হবে। এসব চিন্তা করে ঠিক হলো রেমাক্রি নয়, বগালেক দেখতেই যাচ্ছি আমরা। তবে দ্বিধায় ছিলাম তৃণাকে নিয়ে। ওর আবার একটু শ্বাসকষ্টের সমস্যা। পাহাড় চূড়ায় উঠতে পারবো তো?

কথা ছিল সকালে তাড়াতাড়িই বের হবো আমরা। কিন্তু নাস্তা সেরে বান্দরবান শহরের রুমা বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছাতেই ঘড়ির কাঁটা দশটার ঘর পার করে ফেলল। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। তাই স্ট্যান্ডে গিয়েই টিকিট কেটে চেপে বসলাম বাসে। গন্তব্য পাহাড়ি পথে ৪৫ কিলোমিটার দূরের রুমা বাজার। সেখান থেকে জিপে চড়ে বগালেক।

আমাদের বাস চলছে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা ধরে। চোখের সামনে দিগন্ত বিস্তৃত সারি সারি পাহাড়। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু সবুজের সমারোহ। পাহাড়ের একটা বাঁক থেকে চোখে পড়লো বান্দরবান স্বর্ণমন্দির। এদিকে চলার পথে মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছিল সাঙ্গু নদী। সাঙ্গু এখানে অনেকটাই সরু। দু’ধারে আদিবাসীদের জুম চাষের ক্ষেত। কিছুদূর পর পর চোখে পরবে ছোট-বড় আদিবাসী উপজাতি গ্রাম আর বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর মানুষ। এরা কেউ হয়তো জুম চাষে ব্যস্ত, আবার কেউ তাঁতে বুনছে কাপড়। এসব দেখতে দেথতে কখন যে রুমা বাজার চলে এলাম টেরই পেলাম না। অবশ্য যাত্রাপথের মাঝে পনের মিনিটের একটা বিরতি ছিল।

আমরা রুমা বাজার পৌঁছলাম প্রায় তিন ঘণ্টা পর। বগালেক যেতে হলে গাইড নিতে হবে এখান থেকে। নাম ঠিকানা এন্ট্রি করতে হবে সেনাবাহিনীর চেকপোস্টে। ঠিক করলাম আগে খাওয়া, তারপর আর সব। হোটেলবয়ের মুখে খাবারের আইটেম হিসেবে সাঙ্গু নদীর রুই মাছের কথা শুনে লোভ সামলাতে পারলাম না। দাম একটু বেশি তাতে কি। সাঙ্গুর রুই বলে কথা! অর্ডার করলাম। খাবার পর্ব শেষে গাইড ঠিক করার পালা। আমরা তিনজন। তাই আরেকটি ট্রাভেলার গ্রুপকে ভেড়ালাম আমাদের সাথে। নির্দিষ্ট বুথ থেকে ভাড়া করলাম একজন গাইড। তিনিই আমাদের বগালেক যাওয়ার স্থানীয় জিপ ঠিক করে দিলেন। চেকপোস্টের আনুষ্ঠানিকতাও সারলেন। আমরা নিবন্ধন বইয়ে স্বাক্ষর করে গাড়িতে বসতেই শুরু হলো ১৪ কিলোমিটার দুরের বগালেক যাত্রা। কিছুক্ষণ পরই মুখোমুখি হলাম আসল চ্যালেঞ্জের। পাহাড়ের খাড়া ঢাল। এক একটা ঢাল মনে হয় ৭০-৮০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলের হবে। আর সেই ঢাল বেয়ে জিপের ওঠানামা। কী ভয়ংকর! প্রাণবায়ু এই বের হয়, আবার আসে। দেখলাম সেই ঢাল বেয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে দিব্যি গন্তব্যে চলে যাচ্ছে পাহাড়ি মানুষজন।

প্রায় দেড়ঘন্টা পর কিছুটা হতাশা নিয়েই নিজেদেরকে আবিষ্কার করলাম। “এটাই বগালেক? এ যে ভাটিয়ারি লেকের চেয়েও ছোট,” বলল তৃণা। কিন্তু না, আমাদের হতাশা কাটতে বেশিক্ষণ লাগলো না। বগালেক সেনা ক্যাম্পে নাম-পরিচয় এন্ট্রি করে উঠলাম আমাদের জন্য নির্ধারিত কটেজে। কথা ছিল রাতে বগালেকের পাড়ে থাকবো। তাই রুমা থাকতেই আমাদের গাইড রুম বুকিং দিয়ে রেখেছিল। লেকের পাশে বম উপজাতি গোষ্ঠীর একটি ছোট্ট পাড়া আছে। তারাই পর্যটকদের জন্য খাওয়া-দাওয়াসহ কটেজ সুবিধা দিয়ে থাকে খুব স্বল্পমূল্যে। কটেজে ব্যাগ রেখে বের হলাম। দেখলাম বগালেকের আছে অকৃত্রিম নিজস্বতা। আছে একটা আবেদনময়ী নৈসর্গিক রূপ। আকারে ছোট হলেও অমন মনোহর রূপ নিমিষেই ঘায়েল করতে পারে যে কোন ভ্রমণপিয়াসীকে। আমরাও ঘায়েল হয়েছিলাম। গহীন অরণ্যের নির্জনতার মাঝে পাহাড় চূড়ায় টলমল করা বিশাল জলাধার। আর সে নীল স্বচ্ছ জলে ভাসছে গোলাপি শাপলা। নিস্তরঙ্গ জলে উঁচু পাহাড়ের শ্যামল ছায়া। যেন এক অনুপম আবেশ। শিল্পীর কল্পনার সব রঙ বোধ হয় এখানে। সে রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নিতে নিরস জনও আপত্তি করবে না। উল্লাস দা’র ক্যামেরার ফ্রেমে ক্লিক ক্লিক করে তাই ধরা পড়ল কিছু সুখস্মৃতি।

সন্ধ্যার পরশে আচ্ছন্ন চারপাশ। শীতের কুয়াশার চাদর পেল হাওয়া। বগালেকের প্রকৃতিও রঙ বদলালো। একটু চা খেলে মন্দ হতো না। স্থানীয় মানুষের কাছে এই লেক নিয়ে আছে নানা রূপকথা-উপকথা- ড্রাগনের কথা, নাগরাজের রোষানলের কাহিনী। লেকের পাশে ধূমায়িত চায়ের আড্ডায় বসে হল সেসব গল্প। এখানে একটা গির্জা আছে। সেই গির্জাকে কেন্দ্র করে বড়দিনের উৎসবে মেতেছে এখানকার বম পাড়া। দূরে পাহাড়ের মাথায় উঁকি দিচ্ছে এক ফালি চাঁদ। সে চাঁদের আলোয় লেক পাড়ের সরল মানুষের সাদামাটা উদ্যাপন। এ যেন কঠিনের মাঝেও জীবনকে সহজ করে তোলার এক অন্যরকম আকুতি, অন্য রকম অনুভূতি। পাহাড়ি বন্য এই অরণ্যের মানুষের অনুভূতি যেন আমাদেরও গল্প। যার শেষ নেই।

জুয়েল দাশ : ট্রাভেলার, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!