অভাবের ভয়ে চট্টগ্রাম শহর থেকে গ্রামে ছুটে যাচ্ছে মানুষ

সোমবার থেকে গণপরিবহন বন্ধ, এরপরই কড়া লকডাউন

হাতে আছে এই রোববার সারাদিন। সোমবার ভোর থেকেই সমস্ত গণপরিবহন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে বৃহস্পতিবার থেকে ঘর থেকে বেরোতেই মানা। এমন ঘোষণার পর থেকেই চট্টগ্রাম শহর ছেড়ে ঘরমুখো মানুষ ভিড় জমাচ্ছে দূরপাল্লার বাস টার্মিনালে। কেউবা মোটরসাইকেল-মাইক্রোবাসে করেও নিজ গন্তব্যে পৌঁছার চেষ্টা করছে।

সারাদেশে কঠোর লকডাউনের সরকারি ঘোষণা আসার পরই চট্টগ্রাম শহর ছাড়তে মানুষের ঢল নেমেছে বিভিন্ন টার্মিনালে। শনিবার (২৬ জুন) সন্ধ্যা থেকেই ঘরমুখো মানুষের ভিড় বেড়েছে বিভিন্ন স্পটে। স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করেই শত শত মানুষ গাদাগাদি করে পাড়ি দিচ্ছে বাড়ির পথে।

চট্টগ্রাম নগরীর গুরুত্বপূর্ণ বাস টার্মিনালগুলোর মধ্যে রয়েছে বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল, অক্সিজেন বাস টার্মিনাল, অলংকার বাস টার্মিনাল, মাদারবাড়ি বাস টার্মিনাল, দামপাড়া বাস টার্মিনাল, কদমতলী বাস টার্মিনাল ও শাহ আমানত বাস টার্মিনাল।

অক্সিজেন বাস টার্মিনাল থেকে গাড়ি যাচ্ছে রাঙ্গামাটি, কাপ্তাই ও খাগড়াছড়ি। কদমতলী ও অলংকার বাস টার্মিনাল থেকে ৬৪টি জেলায় গাড়ি চলাচল করলেও বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার কারণে বর্তমানে দূরপাল্লার বাস চলছে দাউদকান্দি, চাঁদপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া রুটে। অন্যদিকে বহদ্দারহাট ও শাহ আমানত বাস টার্মিনাল থেকে গাড়ি চলাচল করছে বান্দরবান, সাতকানিয়া, কক্সবাজারসহ ১৯টি রুটে।

বাস টার্মিনালে অপেক্ষারত যাত্রী সোহেল বললেন, ‘আমি রাজশাহী থেকে আম নিয়ে এসেছিলাম। রাজশাহী লকডাউন চলছে চট্টগ্রামেও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে তাই কোনমতে কম দামে আম বিক্রি করে চলে যাচ্ছি। গাড়ি পেয়েছি। কিন্তু অতিরিক্ত ভাড়াও নিচ্ছে। সাথে গাদাগাদি করে যাত্রী তো আছেই। তাও যেতে হচ্ছে, কিছু করার নেই।’

এদিকে গণপরিবহনের ঘাটতির সুযোগ নিচ্ছে প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাসগুলো। এসব যানবাহন যাত্রী নিয়ে যাচ্ছে দূরের গন্তব্যে। যাত্রীদের গাড়িতে ওঠাতে চালকরাও দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি। এসব যানবাহনে মানা হচ্ছে না কোনও ধরনের স্বাস্থ্যবিধি। গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে একে অপরের পাশে বসছেন দূরের গন্তব্যে যাওয়ার জন্য।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক অলি আহমদ বলেন, ঢাকায় কঠোর নিষেধাজ্ঞার জন্য আমাদের ৪৫ রুটের বাস ঢাকায় প্রবেশ করতে পারছে না। কিন্তু ঢাকার আশেপাশে জেলাগুলোতে যাত্রী যাতায়াত করছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে।’

তিনি বলেন, ‘লকডাউনে পড়ে যাওয়ার ভয়ে সেজন্য দিনমজুর শ্রেণীর মানুষ অল্প অল্প করে গ্রামের বাড়িতে চলে যাচ্ছে। অন্যদিনের তুলনায় যাত্রীও হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে। রোববার এই সংখ্যা আরো বাড়তে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘কক্সবাজার রোডে আমাদের ১৯টি গাড়ি চলাচল করছে। ফটিকছড়ি লকডাউনের কারণে ওই রুট ছাড়া বাকিগুলোতে প্রচুর মানুষ নগর ছাড়তে শুরু করেছে।’

নগরীর বন্দর এলাকায় বসবাসকারী দিনমজুর হাসান আলীসহ কয়েকজনের সাথে কথা বললে তারা জানান, ‘আমরা দিনে এনে দিনে খাওয়া মানুষ। নোয়াখালী থেকে এখানে কাজ করার জন্য আমরা এসেছি। কিন্তু লকডাউনের কারণে কোন কাজকর্ম করতে পারিছি না। তাই কালকে (রোববার) নোয়াখালী চলে যাব সবাই। এখানে শহরে থাকলে না খেতে থাকতে হবে, আমাদের থাকা খাওয়ার জায়গাই নাই। লকডাউন সব শেষ করে দিচ্ছে।’

চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী এমরান মাহমুদ বলেন, ‘সরকার কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে চললেও কেউ দিনমজুর শ্রেণীর মানুষের কথা চিন্তা করছে না। যার ফলে লকডাউন হলেই গ্রাম আর শহরে আসা-যাওয়ার খেলা চলছে এই দিনমজুর শ্রেণীর মানুষের।

নগরীর অলংকার এলাকায় বসবাসকারী এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘অলংকার মোড় থেকে যে কয়টা বাস ছেড়ে যেতে দেখেছি, তার বেশিরভাগই দিনমজুর শ্রেণীর মানুষ। রাত হলে আরও বাড়বে গ্রামমুখী মানুষের সংখ্যা। না হলে এই শহরে তাদের খাওয়াবে কে? যাদের একটু সামর্থ্য আছে তারা শহরেই থেকে যাচ্ছেন। কারণ সামনে ঈদ। এখন বাড়ি গেলে টাকা ছাড়া ঈদের আনন্দ মাটি হয়ে যাবে— এই চিন্তায়। আবার অনেকেই মোটরসাইকেল ও মাইক্রোবাসে করে কুমিল্লা, চাঁদপুরসহ আশেপাশের জেলাগুলোতে গাদাগাদি করে চলে যাচ্ছে।’

বাসচালক সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘আবার লকডাউন শুরু হচ্ছে। গাড়ি বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু কেউ আমাদের চিন্তা করছে না। কালকে বাড়ি চলে যাব। এবার তো আমাদের মরা ছাড়া কোন পথ নেই। তিনটা বাচ্চা আছে। বাবা-মা, ভাই-বোন, বউ নিয়ে এত বড় সংসার একা চালাচ্ছি। তারপর বারবার লকডাউনে আমাদের সংসার খরচ চালাতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এবার আল্লাহ মরণ দিলেই বেশি ভালো হবে, আর কোন পথ দেখছি না।’

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ায় বিশেষজ্ঞদের সুপারিশে বৃহস্পতিবার থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সারাদেশে কঠোর লকডাউন জারির ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এই সময়ে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাড়ির বাইরে বের হতে পারবেন না। জরুরি পরিষেবা ছাড়া সকল সরকারি বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে। জরুরি পণ্যবাহী পরিবহন ছাড়া সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে অ্যাম্বুলেন্স ও চিকৎসা সংক্রান্ত কাজে ব্যবহৃত যানবাহন এবং গণমাধ্যম নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!