অপহরণে পুলিশের তদন্তে সাংবাদিকের অনাস্থা, চট্টগ্রাম প্রতিদিনের সম্পাদকসহ ৩ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে রনির মামলা

অপহরণের ঘটনায় হওয়া মামলায় পুলিশের অভিযোগপত্রকে ত্রুটিপূর্ণ ও পক্ষপাতমূলক বলে জানিয়ে আদালতে নারাজি দিয়েছেন চট্টগ্রামের সাংবাদিক গোলাম সরওয়ার।

মঙ্গলবার (২৮ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম হোসেন মোহাম্মদ রেজার আদালতে এই মামলার শুনানি হয়। তবে মামলার কেস ডকেট (সিডি) না থাকায় বৃহস্পতিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেছেন আদালত।

এদিকে অপহরণের ঘটনায় সাংবাদিক গোলাম সরওয়ার কোতোয়ালী থানায় মামলা করার পরপরই গত বছরের ৯ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের আদালতে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ছোট ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনি ১০০ কোটি টাকার একটি মানহানির মামলা করেন। মামলায় চট্টগ্রাম প্রতিদিনের সম্পাদক হোসাইন তৌফিক ইফতিখার, প্রকাশক আয়ান শর্মা ও সাংবাদিক গোলাম সারোয়ারকে আসামি করা হয়। মামলাটিতে চট্টগ্রামের পিবিআই তদন্ত করে তিন আসামির বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেয়। পিবিআইয়ের সেই তদন্তকে সম্পূর্ণ পক্ষপাতদুষ্ট ও হাস্যকর বলে জানিয়েছেন তিন আসামির আইনজীবীরা। হয়রানিমূলক এই মামলা দায়েরের ঘটনায় চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের (সিইউজে) সভাপতি মোহাম্মদ আলী ও সাধারণ সম্পাদক ম. শামসুল ইসলাম এক বিবৃতিতে প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে যখন সাংবাদিকরা দেশের উন্নয়ন অগ্রগতিতে অগ্রণী ভুমিকা পালন করছে ঠিক তখনই প্রকাশিত সংবাদের জের ধরে দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মানহানি মামলা দায়ের অত্যন্ত দুঃখজনক ও অনাকাঙ্খিত। এ ধরনের মামলা দায়ের গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে খর্ব করার অপচেষ্টা বলে তারা উল্লেখ করেন।

গত বছরের ২৮ অক্টোবর রাতে চট্টগ্রাম নগরীর কাজীর দেউড়ি এলাকায় অপহরণের শিকার হন সাংবাদিক গোলাম সরওয়ার। এর তিন দিন পর ১ নভেম্বর সীতাকুণ্ডের কুমিরা এলাকা থেকে তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় জনতা। এ ঘটনায় ৪ নভেম্বর তিনি নিজেই বাদি হয়ে চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালী থানায় একটি মামলা করেন। চলতি বছরের ৯ মে সেই মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা কোতোয়ালী থানার এসআই ধর্মেন্দু দাশ। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ‘সকল প্রাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণে মামলাটি তথ্যগত ভুল মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে।’ তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, সারোয়ার অপহৃত হয়েছিলেন, এমন কোনো তথ্য-প্রমাণ তদন্তে পাওয়া যায়নি। সারোয়ারও অপহৃত হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করতে পারেননি। এ কারণে মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।

চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই ধর্মেন্দু দাশ মন্তব্য করেছেন, বাদী মোটা। তার পরনে ছিল কালো গেঞ্জি। মোটরসাইকেলচালকের হেলমেট ছিল। বাদী অপহরণের শিকার হলে ফুটেজে দেখা যেত। এফএনএফ ইলেকট্রনিকসের সামনে ভিআইপি টাওয়ারের কাছে দুজন নিরাপত্তাকর্মী ছিলেন। ব্যাংকের বুথেও ছিলেন একজন নিরাপত্তাকর্মী। তাঁরা কেউ বাদীকে দেখেননি। বাদী সুঠামদেহী হওয়ায় তাকে চেতনানাশক দেওয়ার চেষ্টা হলে ধস্তাধস্তি হওয়ার কথা। এমন কিছু হওয়ার তথ্য তারা পাননি।

অজ্ঞাতস্থানে থাকার সময় কথোপকথনে সংবাদ লেখার কারণে বাদীকে অপহরণ করা হয়েছে বলে যে দাবি সারোয়ার করেছেন, তার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। চিকিৎসক বাদীর কাঁধ ও পায়ে ভোঁতা অস্ত্রের সামান্য আঘাতের চিহ্ন পেয়েছেন। এই আঘাতও সামান্য। সারোয়ারের অভিযোগের সঙ্গে তা মেলে না।

তদন্তকারী কর্মকর্তা যুক্তি দেখিয়েছেন, সারোয়ার উদ্ধারের পর তাঁর মুখে দাড়ি ছিল না। তিন দিন অজ্ঞাতবাসে থাকলে তাঁর দাড়ি ওঠার কথা।

গোলাম সরওয়ারের দায়ের করা মামলার তদন্তে তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ পুলিশের ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। ফরমায়েশি তদন্ত প্রতিবেদনে তারই প্রতিফলন দেখা গেছে বলে জানান সাংবাদিক গোলাম সরওয়ার।

বাদীপক্ষের আইনজীবী খন্দকার আশরাফ উদ্দিন রনিও বলেছেন, ‘দেশজুড়ে আলোচিত হওয়া এই সাংবাদিক অপহরণের ঘটনায় পুলিশ দায়সারা তদন্ত করে অপহরণের কোনো আলামত পায়নি বলে অভিযোগপত্রে জানায়। দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করার পর তারা জামিনে চলে যাওয়ার পর রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা। সরওয়ারের খোয়া যাওয়া মোবাইল ফোন ও টাকা উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। এ রকম অসংখ্য ত্রুটি রয়েছে তদন্তে। এটি একটি চরম দায়সারা অভিযোগপত্র ও পক্ষপাতমূলক তদন্ত হওয়ায় আমরা এতে অনাস্থা এনে মামলাটি অধিকতর তদন্ত করার আবেদন জানিয়েছি।’

রনির ১০০ কোটি টাকার মানহানির মামলা

এদিকে অপহরণের ঘটনায় সাংবাদিক গোলাম সরওয়ার কোতোয়ালী থানায় মামলা করার পরপরই গত বছরের ৯ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের আদালতে আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনি ১০০ কোটি টাকার একটি মানহানির মামলা করেন। মামলায় চট্টগ্রাম প্রতিদিনের সম্পাদক হোসাইন তৌফিক ইফতিখার, প্রকাশক আয়ান শর্মা ও সাংবাদিক গোলাম সারোয়ারকে আসামি করা হয়। মামলাটি চট্টগ্রামের পিবিআই তদন্ত করে তিন আসামির বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেয়। পিবিআইয়ের সেই তদন্তকে সম্পূর্ণ পক্ষপাতদুষ্ট ও হাস্যকর বলে জানিয়েছেন তিন আসামির আইনজীবীরা।

ওই মামলার বাদি আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনি ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ছোট ভাই। তিনি বেসরকারি ব্যাংক ইউসিবির নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যানও।

সাপ্তাহিক আজকের সূর্যোদয়ের স্টাফ রিপোর্টার সিটি নিউজ বিডি ডটকমের নির্বাহী সম্পাদক ও প্রকাশক। সেখানে ‘চট্টগ্রামে ব্যবসায়ীর জমিতে ভূমিমন্ত্রীর ভাইয়ের কুদৃষ্টি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ প্রতিবেদনের কারণেই বিপদে পড়েছেন বলে মনে করছেন সারোয়ার।

গত বছরের ৪ নভেম্বর চট্টগ্রাম প্রতিদিনে গোলাম সরওয়ারের সহকর্মীদের বরাত দিয়ে ‘চট্টগ্রামে সাংবাদিক নিখোঁজের নেপথ্যে কি দুই রিপোর্ট’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেই প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের নিজস্ব কোনো বক্তব্য না থাকলেও গত বছরের ৯ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের আদালতে আনিসুজ্জামান চৌধুরী ১০০ কোটি টাকার একটি মানহানির মামলা করেন।

সাংবাদিক গোলাম সরওয়ার বলেন, ‘কোতোয়ালী থানায় মামলা দায়েরর পর নানা ধরনের হুমকি ও গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যা চেষ্টাসহ নানাভাবে আমাকে হয়রানি করেন প্রভাবশালীরা। আপনারা শুনে অবাক হবেন, আমাকে অন্যায়ভাবে অপহরণ করে নির্মম নির্যাতনের পর সংবাদ প্রকাশ করায় কারণে দেওয়া হয় মিথ্যা মামলা। আমার বিরুদ্ধে দুটি মানহানি মামলা দায়ের করেছেন চট্টগ্রামের প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য ভূমিমন্ত্রীর ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী। অপরদিকে আনিসুজ্জামান চৌধুরীর একান্ত সচিব মোহাম্মদ বোরহান উদ্দিন চৌধুরীর আবেদনের প্রেক্ষিতে চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি চট্টগ্রামের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ‘সিটি নিউজে’ সংবাদ প্রকাশ সংক্রান্ত কারণে আমাকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেন।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!