অপহরণের ৭২ ঘন্টার রুদ্ধশ্বাস বয়ান দিলেন ‘বোনাস লাইফ’ পাওয়া বেলাল

কেন অপহরণ— বলতে ‘বারণ’

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিন (২৭ জানুয়ারি) ভোররাত ৪টায় নগরীর ফিরোজশাহ্ কলোনি থেকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় যুবলীগ কর্মী বেলাল উদ্দিন জুয়েলকে। অপহরণের ৭২ ঘণ্টা পর পটিয়া উপজেলার ভাটিখাইন এলাকা থেকে হাত পা বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার হন জুয়েল। অবসান হয় পরিবারের উৎকন্ঠার। তবে এখনও রহস্য রয়ে গেছে সেই এক প্রশ্নে— কারা অপহরণ করেছিল জুয়েলকে? কেনই বা তাকে অপহরণ করা হয়েছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যোগাযোগ করা হয় বেলাল উদ্দিন জুয়েলের সাথে।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনের সঙ্গে মুখোমুখি আলোচনায় অনেক কিছু গোপন রেখে অনেক তথ্যই জানালেন অপহৃত বেলাল উদ্দিন জুয়েল।

জুয়েল বলেন, ‘ভোটের আগের রাতে (২৭ জানুয়ারি) তিনটার দিকে দরজায় কড়া নাড়ে কিছু লোক। আমি তখন আকবরশাহ এলাকায় খালার বাসায় ছিলাম। আমার খালাতো ভাই দরজা খুললে অপরিচিত কয়েকজন লোক জিজ্ঞেস করলো, এখানে বেলাল উদ্দীন জুয়েল কে? আমি নিজের পরিচয় দিতেই তারা হাত ও চোখ বেঁধে আমাকে তুলে নেয় একটি মাইক্রোবাসে। আমি কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়।’

জুয়েল বলেন, ‘আমার পরিবারকে বলা হয়, তারা র‌্যাব। পরদিন যেন তারা র‌্যাব অফিসে গিয়ে আমার খোঁজখবর নেয়। কিন্তু র‌্যাব পরিচয়ে অপহরণকারীরা আমাকে র‌্যাব অফিসে না নিয়ে ঘুরতে থাকে ৪ ঘণ্টা। কোথায় কেন কী অপরাধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সে প্রশ্নগুলো করার আগেই উত্তর দেওয়া হয়েছিল— ‘চুপ, একদম চুপ, কোনো কথা হবে না’।

জুয়েল আরও বলেন, ‘দীর্ঘ ৪ ঘণ্টা গাড়িতে ঘোরানোর পর আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি কক্ষে— যেখানে কোনো ধরনের আলো আসার ব্যবস্থা ছিলো না। শুধুমাত্র দুই বেলা খাবার দেওয়ার সময় খোলা হতো আমার হাত ও চোখ। সে সময় চোখ দিয়ে আশপাশে দেখে এতটুকু বুঝলাম যে আমি এখনও বেঁচে আছি।’

সে সময়ের অনিশ্চিত জীবনের কথা স্মরণ করে জুয়েল বলেন, ‘আমার চারদিকে চারটি দেওয়াল ছাড়া আর কিছুই ছিলো না রুমটিতে। হাত পা চোখ বাঁধা অবস্থায় মেঝেতেই কেটেছে আমার তিনদিন-তিনরাত। আমার কথা কেউ শোনে না। কিছু জিজ্ঞেস করলেও বলে না। শুধু একটাই উত্তর সেটা হলো ‘চুপ’। আমার আশেপাশে লোকজনের উপস্থিতি বুঝতে পারলেও চোখ বন্ধ থাকায় কাউকেই দেখার সুযোগ হয়নি। আর আমি ওদের কথা শুনতে পারবো সে সন্দেহে তারাও ফিসফিস করে কথা বলতো।’

কোনো ধরনের নির্যাতন বা কী কারণে নিয়ে গেছে জানতে চাইলে জুয়েল একটু চুপ থেকে একটু রহস্য রেখে বলেন, ‘না, আমাকে মারেনি। আর কেন বা কী কারণে নিয়ে গেছে তা আর আমি জানতেও চাই না। আমি এখনও বেঁচে আছি সেটাই আমার প্রাপ্তি, আর কোনো কিছু চাই না। আর এর বাইরে কোনো কিছু আমি বলতে পারবো না। বলা বারণ আছে। কিছু নির্দেশনাও আছে। বোঝেন তো!’

অপহরণের স্মৃতি ও ভয় যে এখনো কাটেনি তা জুয়েলের কথায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। আর তিনি কিছু একটা বলতে চেয়েও যেন বলতে পারছেন না কোন এক অজানা ‘নিষেধাজ্ঞা’র কারণে।

তিন দিন পর হঠাৎ ছেড়ে দেওয়ার কথা জানাতে গিয়ে জুয়েল বললেন, ‘যেদিন মুক্তি দেওয়া হবে সেদিন আবার হাত-চোখ বাঁধা অবস্থায় গাড়িতে তুললো। আগের মতো করে ৩-৪ ঘণ্টা ঘুরিয়ে আমাকে পটিয়ায় রাস্তার ওপর ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেয়। পরে আমার মোবাইল থেকে আমার স্ত্রী কানিজ ফাতেমাকে ফোন করি। তারপর ওরা এসে আমাকে নিয়ে যায়। এখন আমি আমার বোনাস লাইফ পার করছি।’

র‌্যাব পরিচয়ে যারা অপহরণ করেছে তাদের বিরুদ্ধে কোন মামলা করবেন কিনা এই প্রশ্নের উত্তরে জুয়েল বলেন, ‘না, আমি কোনো মামলাতে যাবো না। বেঁচে আছি— আমি এতটুকুতেই সন্তুষ্ট।’

নিখোঁজ জুয়েলের সন্ধানে যখন তার পরিবার র‌্যাব, ডিবি, পুলিশ সব অফিসে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত তখনই অজ্ঞাত কারণে পটিয়ায় মধ্যরাতে ফেলে যেতে বাধ্য হয় অপহরণকারীরা।

এতকিছুর পরও খুশি জুয়েলের পরিবার। সংসারের প্রধান কর্তাকে জীবিত ফিরে পেয়েছে তাতেই খুশি সকলে। ৮ বছরের শিশু কন্যা জওরা ও দেড় বছরের জাহিনও খুশি তাদের বাবাকে ফিরে পেয়ে।

এর আগে শুক্রবার (২৯ জানুয়ারি) জুয়েলের পরিবার থেকে সংবাদ সন্মেলনের আয়োজন করা হয়। ওই সংবাদ সম্মেলন থেকে জুয়েলকে ফিরে পাওয়ার প্রার্থনা জানায় তার পরিবার। এখন জুয়েলকে ফিরে পেয়ে সব অভিযোগ ও সন্দেহের কথা আর মনে করতে চাইছেন না জুয়েলের স্ত্রী কানিজ ফাতেমাও।

ফাতেমা বলেন, ‘জীবিত জুয়েল ঘরে ফিরেছে— এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর কিছু নেই।’

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগের সভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সদস্য বেলাল উদ্দীন জুয়েলকে মঙ্গলবার (২৬ জানুয়ারি) দিবাগত রাত সাড়ে ৪টার দিকে র‌্যাব পরিচয় দিয়ে ১০ থেকে ১২ জন মাইক্রোতে তুলে নিয়ে চলে যায়। সাথে সাধারণ পোশাকে পুলিশ সদস্যও ছিল। র‌্যাবের সদস্যরা জুয়েলের পরিবারকে র‌্যাব কার্যালয়ে যোগাযোগের জন্য বলে যান।

পরদিন নির্বাচন হওয়ায় র‌্যাব কার্যালয়ে যেতে পারেননি বেলালের পরিবার। বৃহস্পতিবার ২৮ তারিখ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে দশটায় র‌্যাব কার্যালয়ে গেলে বলা হয় গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে যেতে। সেখানে যোগাযোগ করলে গোয়েন্দা পুলিশ থেকে আকবরশাহ থানায় যোগাযোগ করতে বলা হয়। বৃহস্পতিবার সারাদিন বেলালের বড় ভাই ও স্ত্রী চার থেকে ৫ বার থানায় গিয়েছেন নিখোঁজ ডায়েরি করতে। কিন্তু আকবরশাহ থানা পুলিশ কোনো সাধারণ ডায়েরিও নেয়নি।

কেএস/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!