অপবাদে আত্মহত্যার কথা ভাবেন চট্টগ্রামসহ তিন জেলার বিদেশফেরত নারীরা

চট্টগ্রামের ফরিদা বেগম (ছদ্মনাম) এক বছর জর্ডানে ছিলেন। সেখানে বন্দি রেখে তার ওপর নিয়মিত শারীরিক নির্যাতন চালানো হতো। দেওয়া হতো না খাবারও। একসময় প্রাণ বাঁচাতে ফরিদাসহ তার সঙ্গে বন্দি আরও দুই নারী পাশের একটি তিনতলা ভবনের ছাদে লাফিয়ে কোনরকমে পালিয়ে যান। কিন্তু লাফ দেওয়ার পর আঘাত লেগে ফরিদার স্থায়ী শারীরিক জটিলতা তৈরি হয়েছে। চলেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। বাংলাদেশ মিশনের সাহায্যে ফরিদা দেশে ফিরে আসেন, কিন্তু স্বামী তাকে ঘরে তোলেননি।

ফরিদা বলেন, আমার স্বামী বলে ‘অন্য কোন মেয়ে হলে লজ্জায় মরে যেতো, তুই কেন বেঁচে আছিস?’ তাই এখন থাকতে হচ্ছে বাবার বাড়িতে। সেখানে ভাইবোনেরাও তার সাথে কথা বলে না। খুব জরুরি দরকার ছাড়া বাড়ির বাইরেও যান না ফরিদা। পাড়া-প্রতিবেশী সকলেই ঘৃণা আর অবজ্ঞার চোখে দেখে বর্বরতার শিকার ফরিদাকেই। তিনি বলেন, গত রমজানে আমাকে কেউ সাহায্য দেয়নি, কোরবানি ঈদেও গোশত দেয়নি। সবাই বলে, দরকার হলে কুকুরকে খাওয়াব, তাও তোকে এক টুকরোও দেব না। তাতে কোনো সওয়াব হবে না!

সামাজিক গঞ্জনা ও দুর্ব্যবহারে দিন দিন ভেঙে পড়ছেন বিদেশ থেকে ফেরা চট্টগ্রামের ফরিদা বেগম। প্রতিদিন এমন সব অপমানের শিকার হয়ে মাঝেমধ্যেই এখন আত্মহত্যার কথা ভাবেন তিনি। এই অবস্থায় দেশের বাইরে যাওয়াই তার কাছে মুক্তির একমাত্র উপায় বলে জানিয়ে ফরিদা বলেন, ‘জানি না এভাবে কিভাবে বাঁচব, আরেকবার বিদেশ যেতে পারলে হয়তো সবকিছু সামলে ওঠা যাবে।’

ফরিদা একা নন, প্রবাস থেকে ফেরা নারীদের ৬০ শতাংশই বর্তমানে বেকার। ৬৫ শতাংশের নিয়মিত কোনো মাসিক আয় নেই। অন্যদিকে ৬১ শতাংশ নারী এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন ঋণের বোঝা।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বিলস ২০২০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম, যশোর এবং ফরিদপুরের ৩২৩ জন বিদেশফেরত অভিবাসী নারীর ওপর জরিপ চালায়।

ওই গবেষণায় দেখা যায়, বিদেশফেরত নারীদের ৫৫ শতাংশ শারীরিকভাবে ও ২৯ শতাংশ মানসিকভাবে অসুস্থ। ৮৭ শতাংশ নারী দেশে আসার পরও মানসিক অসুস্থতার কোনো চিকিৎসা পাননি। ৭৫ শতাংশ নারীর কোনো সঞ্চয় নেই। ৭৩ শতাংশ নারী তাদের পরিবারের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছেন। আবার ৩৮ শতাংশ নারীকে সমাজে নিম্ন শ্রেণীর ‘চরিত্রহীন নারী’ বলে গণ্য করা হয়।

এসব নারী শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত পারিবারিক ও সামাজিকভাবেও প্রতিনিয়ত হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে চরম অমানবিক আচরণের শিকার হচ্ছেন।

বিলসের গবেষণা উপ-পরিচালক মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় বিদেশ গিয়ে ২৩ শতাংশ নারী শ্রমিক এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই দেশে ফিরেছেন। ১৮ শতাংশ নারী এক বছরের সামান্য বেশি সময় থেকেছেন। আবার ৫৫ শতাংশ নারীর দেশে ফেরত আসা ছিল জবরদস্তিমূলক।’

গবেষণায় দেখা গেছে, বিদেশে যাওয়া ৫২ শতাংশ নারীকে জোরপূর্বক কাজ করানো হয়েছে সেখানে। ৬১ শতাংশ নারী খাদ্য ও পানির অভাবে ভুগেছেন প্রবাসের কর্মক্ষেত্রে। অন্যদিকে ৭ শতাংশ নারী যৌন নির্যাতন এবং ৩৮ শতাংশ নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

ফরিদপুরের মমতাজ নামের এক বিদেশফেরত নারীর মা বলেন, ‘আমার মেয়ে খুবই অসুস্থ। বিদেশে থাকার সময় ওকে দেশে কারও সাথে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি। না খাইয়ে রাখা হতো। এভাবে কিছুদিন চলার পর সে সম্পূর্ণ পাগল হয়ে গেছে।’

গবেষণাটির পরিচালক নাজমা ইয়ামিন বলেন, ‘বিদেশ থেকে ফেরার সময় পরিবারের সদস্য দ্বারা বিমানবন্দরেই অযাচিত আচরণের শিকার হয়েছেন ১৭ শতাংশ নারী শ্রমিক। বিদেশ থেকে ফিরে আসা ১৫ শতাংশ নারী তালাকপ্রাপ্ত হয়েছেন। ১১ শতাংশ নারী শ্রমিকের স্বামী তাদের ছেড়ে চলে গেছে এবং ২৮ শতাংশ দাম্পত্য জীবনে বিরূপ প্রভাবের সম্মুখীন হয়েছেন।’

তাদেরই একজন যশোরের নিলুফার বেগম বলেন, ‘সেখানে অনেক সমস্যার মুখে পড়েছি। ছোটখাটো ভুল হলেই আমার চাকরিদাতা মারপিট করতো। তাই সেখান থেকে পালিয়ে যাই। কিন্তু আমার দরকারি সব কাগজ কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। বিদেশে থাকা দেশের মানুষও একবার আমাকে সাহায্য করতে অস্বীকার করে। কিন্তু আমি আশা হারাইনি।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!