অনুসন্ধান/ সীতাকুণ্ডের জেলেপল্লীতে পুলিশের ‘নিত্য চাঁদাবাজি’, প্রতিবাদ হতেই রাতভর চললো মুহুর্মুহু গুলি

সীতাকুণ্ডের কুমিরায় ২০ মে মধ্যরাতে পুলিশের নির্বিচার গোলাগুলির আতঙ্কে এখনও আঁতকে উঠছে জেলেপল্লীর বাসিন্দারা। এ ঘটনায় পুলিশের লাঠির আঘাতে এক বৃদ্ধা নিহত হওয়ার ঘটনাটিও ধামাচাপা দেওয়ার পথে। পুলিশ বাদি হয়ে ৫৯ জনের নাম উল্লেখ করে জেলেপল্লীর আরও ৬০০ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করলেও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ উত্তর জেলা কমিটি এ মামলা নিয়ে চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছে।

পূজা উদযাপন পরিষদ চট্টগ্রাম উত্তর জেলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নিখিল কুমার নাথ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মামলাটির বাদিও জানেন না মামলার আসামি কারা। কারণ পুলিশ বাদি হয়ে যে মামলা দায়ের করেছে, তা প্রশ্নবিদ্ধ। এটি জজমিয়ার নাটককেও হার মানিয়েছে। ওই মামলার আসামিদের মধ্যে পাঁচজন রয়েছে প্রবাসে। আসামিরা প্রবাসে থেকে কিভাবে পুলিশের ওপর কথিত হামলায় অংশ নিল তা আমাদের জানা নেই।’

জেলেদের যেখানে নূন আনতেই পান্তা ফুরায়, সেখানে সত্যিই কি তারা মাদক ব্যবসা কিংবা মাদক সেবনের সঙ্গে জড়িত?
জেলেদের যেখানে নূন আনতেই পান্তা ফুরায়, সেখানে সত্যিই কি তারা মাদক ব্যবসা কিংবা মাদক সেবনের সঙ্গে জড়িত?

কী ঘটেছিল সেই রাতে?
২০ মে রাত ৯টার দিকে সীতাকুণ্ড থানার এসআই জসিম এসে রুবেল জলদাস নামের এক যুবককে ইয়াবাসেবী হিসেবে অভিযুক্ত করে ধরে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর পুলিশ তাদের সোর্সের মাধ্যমে টাকা দাবি করে। এ নিয়ে জেলেপল্লীর বাসিন্দাদের সঙ্গে পুলিশের কথা কাটাকাটি হয়। পুলিশ একপর্যায়ে জেলেপল্লীর লোকজনের ওপর চড়াও হয়। পুলিশের হামলায় বিলম্ব দাস নামের এক মহিলার মৃত্যু হয় বলে অভিযোগ করেন বাসিন্দারা। বিলম্ব রাণীর মৃত্যুর খবর জেলেপাড়ায় ছড়িয়ে পড়লে পুলিশ ও জেলেদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। রাত প্রায় ১২টায় অতিরিক্ত পুলিশ এসে প্রায় ২০০ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে এবং জেলেদের বাড়িতে ঢুকে ভাঙচুর চালায়। রাত ২টা পর্যন্ত পুলিশের সঙ্গে এ সংঘর্ষে জলদাসপাড়ার ৩৫ জন নারী-পুরুষ আহত হয়। আহতদের হাসপাতালে নিতেও বাধা দেয় পুলিশ—এমন অভিযোগ এলাকাবাসীর। ওই রাতে পুলিশ অন্তত দুই ঘন্টারও বেশি সময় ধরে তাণ্ডব চালায় সেখানে। হামলায় পুলিশ ছাড়াও স্থানীয় কমপক্ষে ৩০০-৪০০ লোক ছিল বলে জানা যায়।

জেলে পল্লীর ডানু জলদাস চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, পুলিশ যখন রুবেল জলদাসকে আটক করে তখন বিলম্ব রাণী পুলিশের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কেন ধরা হচ্ছে তাকে। এতেই পুলিশ চড়াও হয় তার ওপর। পরে পুলিশের লাঠির আঘাতেই বিলম্ব রাণীর মৃত্যু হয়। তবে এলাকাবাসীর অভিযোগ, প্রশাসনের চাপে তার পরিবারের লোকজন এখন বলছে, পুলিশের গুলির শব্দে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বিলম্ব রাণী জলদাস।

রোজ সন্ধ্যার পর থেকেই জেলেপাড়ায় নেমে আসে অজানা আতঙ্ক।
রোজ সন্ধ্যার পর থেকেই জেলেপাড়ায় নেমে আসে অজানা আতঙ্ক।

জেলে পাড়ার অদুরী বালা জলদাস অভিযোগ করে বলেন, জেলেপাড়ায় আমরা খুবই গরিব। পুলিশের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে গেছি। প্রত্যেক দিন পুলিশ না হয়, পুলিশের সোর্স এসে আমাদের কাছ থেকে চাঁদা দাবি করে। না দিলে ইয়াবা দিয়ে চালান দেওয়ার ভয় দেখায়। এই নিয়ে প্রশাসনকে বিচার দিয়েও কোন লাভ হয়নি। উল্টো বিপদ আমাদের ওপরে এসে পড়ে।

পুলিশের এমন আচরণে দিশেহারা বড় কুমিরার জেলেপল্লীর হতদরিদ্র মানুষগুলো। এদের কাছে রাত আসলেই আতংকের নাম হয়ে উঠেছে পুলিশ। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা না পাওয়ারও অভিযোগ রয়েছে তাদের। জেলেপাড়ার লক্ষী রাণি বলেন, ‘আমার স্বামী সাগর থেকে জাল নিয়ে বাড়িতে আসার সঙ্গে সঙ্গেই গাঁজা ব্যবসার অপবাদ দিয়ে পুলিশ ও পুলিশের সোর্স তাকে ধরে বেপরোয়া পেটাতে থাকে। স্বামীকে মারধর থেকে বাঁচাতে এবং পুলিশের গ্রেপ্তার এড়াতে আমি এবং আমার পাঁচ ছেলে মেয়ে পুলিশ ও সোর্সদের হাতে পায়ে ধরেও রেহাই পাইনি। আমার এক বছরের ছেলেকেও বেশ মেরেছে পুলিশ। পরে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়া পায়। বেশ কিছুদিন ধরে পুলিশ আমাদের জেলেপল্লীতে এভাবে অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে।

রাত প্রায় ১২টায় অতিরিক্ত পুলিশ এসে প্রায় ২০০ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে
রাত প্রায় ১২টায় অতিরিক্ত পুলিশ এসে প্রায় ২০০ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে

সন্ধ্যা নামলেই অজানা আতঙ্ক
সীতাকুণ্ডের কুমিরা ঘাটঘর জেলেপাড়ায় প্রায় ৫০০ পরিবারে অন্তত দুই হাজার সদস্যের বসবাস। সন্ধ্যার পর থেকেই সেখানে নেমে আসে অজানা আতঙ্ক। এলাকার সবাই জানে, কারণে কিংবা অকারণে রাতের কোনো না কোনো সময় পাড়ায় নামবে পুলিশের সোর্স নামধারী মাদক ব্যবসায়ী কিংবা অপরাধজগতের কেউ না কেউ। সংকেতের অপেক্ষায় অদূরে দাঁড়িয়ে থাকে সীতাকুণ্ড থানা পুলিশের পিকআপ, ভাড়ায় আনা টেম্পো আর কখনও কখনও সিএনজিচালিত অটোরিকশা। প্রতি রাতেই পাড়ার কোনো না কোনো ঘরে হানা দেয় পুলিশ। অপরাধী না হয়েই রাতের আঁধারে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় জেলেদের কারোর ভাই, কারোর বাবা, আর কারো সন্তান কিংবা স্বামীকে। এভাবেই রাত কাটে সীতাকুণ্ড কুমিরা ঘাটঘর জেলেপাড়ার প্রায় ৫০০ পরিবারের।

কেন নিয়ে যাওয়া হয়?
পুলিশের অভিযোগ সবসময়ই এক—আটক ব্যক্তি ইয়াবা কিংবা মাদক ব্যবসায় জড়িত। কখনও কখনও আবার বলা হয় মাদক সেবনের কথা। কিন্তু জীবন আর জীবিকার তাগিদে দূরগ্রামের এই জেলেদের যেখানে নূন আনতেই পান্তা ফুরায়, সেখানে সত্যিই কি তারা মাদক ব্যবসা কিংবা মাদক সেবনের সঙ্গে জড়িত? এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজতে অনুসন্ধানে নামে চট্টগ্রাম প্রতিদিন।

আটকের পর কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়?
নিয়ম অনুযায়ী আটকের পর যে কাউকে নিয়ে যাওয়ার কথা থানায়। কিন্তু জেলেপাড়ার লোকজনকে আটকের পর বেশিরভাগ সময়ই থানায় না নিয়ে জেলেপাড়ার অদূরে পুলিশবাহী গাড়িতে রাখা হয়। ৩০ মিনিট থেকে এক ঘন্টা সময় পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকে পুলিশ। উদ্দেশ্য দফারফা। এ সময়ের মধ্যে যদি দফারফা না হয়, তাহলে আটক ব্যক্তিকে গাড়িতে চোখ বেঁধে বিভিন্ন অভিযানে নিয়ে যাওয়া হয়। আর এর মধ্যেই চলে দেনদরবার।

কারা জড়িত দেনদরবারে?
দেনদরবারে প্রতিবারই পুলিশের সঙ্গে নিয়ে আসা হয় সোর্স নামধারী সন্ত্রাসী কিংবা চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীদের। এদের সঙ্গে থাকে ইয়াবাসহ মাদকদ্রব্য। দফারফায় ব্যর্থ হলেই মাদকের মামলার তালিকায় নাম উঠে যায় জেলেদের। এরপর কারাগারই হয় তাদের আশ্রয়স্থল। টাকার অভাবে জামিনও হয় না অনেকের। জামিনে এসেও জেলেরা শান্তিতে ঘুমাতে পারে না। পুলিশী হয়রানিতে রাত কাটে তাদের।

সোর্স কারা?
চিহ্নিত সন্ত্রাসী কিংবা মাদক ব্যবসায়ীরাই পুলিশের হয়রানি থেকে বাঁচতে নিরীহ জেলেদের পুলিশের হাতে তুলে দেয়। তাদের মধ্যে রয়েছে পুলিশের সোর্স শাহাবউদ্দীন, শাহাজান, ইব্রাহিম, বশর।

সোর্সরাও পায় কমিশন
পুলিশের এই আটকবাণিজ্যে সরাসরি লাভবান হয় সোর্সরাও। বিনিময়ে তারা পায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কমিশন। গ্রেপ্তারের হুমকিতে জেলেদের থেকে পুলিশের আদায় করা টাকা থেকেই ওই কমিশন দেওয়া হয় বলে জানান স্থানীয়রা।

পূজা উদযাপন পরিষদের নিন্দা
২০ মে সীতাকুণ্ড কুমিরা জেলেপাড়া পুলিশ ও বহিরাগত সন্ত্রাসী কর্তৃক জেলেদের ঘরবাড়ি ভাঙচুর, মহিলাদের শারীরিক নির্যাতন ও পূজামণ্ডপ ভাংচুরের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ উত্তর জেলার নেতারা। তারা ২২ মে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সভাপতি নটু কুমার ঘোষ, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ও এডিশনাল পিপি নিখিল কুমার নাথ, সাবেক সভাপতি এডভোকেট শিবু প্রসাদ দেওয়ানজী, অমৃত দে, সাবেক সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব চৌধুরী, সহ সভাপতি গণপতি, যুগ্ম সম্পাদক দীপক পাটোয়ারী, লিপটন দেবনাথ, সীতাকুণ্ড পুজা পরিষদের সভাপতি বিমল নাথ, সাধারণ সম্পাদক স্বপন বণিক, সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রণজিত, সহ সভাপতি সুনীল, সীতাকুণ্ড জন্মাষ্টমী উদযাপন পরিষদের সভাপতি বিষন্ন পদ, সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিত পাল, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি পংকজ নাথ।
তারা এক বিবৃতিতে নিরীহ জেলেদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, গণগ্রেপ্তার ও হয়রানি বন্ধ, পুলিশের সোর্স শাহাজান, শাহিন, বশর ও মাদক ব্যবসায়ী জহুরকে গ্রেপ্তার, নিরীহ জেলেদের ওপর হামলাকারী পুলিশ সদস্যদের শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থার দাবি জানান।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!