অনাহারে বিপন্ন প্রাণীদের বাঁচাতে চট্টগ্রামে ৪ তরুণীর দৌড়ঝাঁপ

মানুষ মানুষের জন্য। বিপদে পড়লে মানুষই মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসে। করোনা ভাইরাসের কারণে নিরাপত্তাকর্মীরা ছাড়া চট্টগ্রাম নগরীর বেশিরভাগ মানুষই গৃহবন্দি। এমন অবস্থায় চট্টগ্রাম নগরীতে সবচেয়ে বেশি অভাবে পড়ে গেছে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। তবে হঠাৎ করেই একেবারে মরণদশায় পড়ে গেছে অবলা প্রাণীগুলো— যাদের কথা ভাববার লোকই খুঁজে পাওয়া কঠিন। এমন সময়ে চট্টগ্রামের কিছু তরুণ-তরুণী অসীম ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন অসহায় প্রাণীদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করার চেষ্টায়।

নগরীর অলিগলি ও রাস্তায় কুকুর-বিড়ালসহ নানা ধরনের প্রাণীর বসবাস— যারা নগরেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। রাস্তার ডাস্টবিনে ফেলা পচাগলা খাবার খেয়েই তাদের উদরপূর্তি হয়। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে বিভিন্ন হোটেল, রেস্টুরেন্ট, দোকানপাট বন্ধের কারণে ডাস্টবিনগুলোতে কোনো উচ্ছিষ্ট খাবার ফেলা হচ্ছে না। এর ফলে বেকায়দায় পড়ে গেছে এই অবলা অসহায় প্রাণীরা। শহরের বিভিন্ন বাসার গেইটও এখন তালাবদ্ধ থাকায় তারা সেখানেও যেতে পারছে না। মানুষও ঘর থেকে বের হচ্ছে না। তাই এদের দেখার মতো যেন কেউই নেই। এসব পশুপাখিরা এখন মরণদশায়। ঠিক এমন পরিস্থিতিতে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘অ্যানিমেল কেয়ার অব চট্টগ্রাম’-এর মডারেটর উষা আচার্য্যের মাথায় আসে সেই অসহায় প্রাণীগুলোর জন্য কিছু করার ভাবনা।

হঠাৎ কেন এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ— জবাবে উষা আচার্য্য চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বললেন, ‘আমার মতে এই সময়টাতে মানুষের চেয়েও সবচেয়ে বেশি দুরবস্থায় আছে পশুপাখিগুলো। কারণ দেশের করুণ অবস্থা দেখে অনেক মানুষ খাবার মজুদ করে রেখেছে। আর যারা খেটে খাওয়া মানুষ আছে, সরকার ছাড়া তারা কোনো না কোনোভাবে কারও না কারও সাহায্য পাচ্ছে বা পাওয়ার অপেক্ষায়। এর ফলে মানুষ হয়তো না খেয়ে মরবে না। কিন্তু এমন অবস্থা চলতে থাকলে নিশ্চিত মরবে এই অবলা পশুপাখিগুলো। কারণ এরা তো মানুষ না যে, আগে থেকেই খাবার মজুদ করে রাখবে। ডাস্টবিনেও তারা এখন খাবার পাচ্ছে না। আমি মনে করি মানুষের চেয়ে পশুপাখির সাহায্য বেশি প্রয়োজন। কারণ মানুষ কাজ না করে কারো থেকে খুঁজেও খেতে পারে। কিন্তু পশুপাখিগুলো তো সেটাও পারছে না। কারণ তারা তো মানুষ না যে মানুষের মতো কথা বলে খুঁজে খাবে। তাদের এই না বলা কথা কেই বা শুনে আর কেই বা বুঝবে। তাছাড়া স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। তাই আমি চিন্তা করেছি এই পশুপাখিগুলোর জন্য খাবারের ব্যবস্থা করবো।’

অনাহারে বিপন্ন প্রাণীদের বাঁচাতে চট্টগ্রামে ৪ তরুণীর দৌড়ঝাঁপ 1

নগরীর বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেওয়ানহাট থেকে টাইগারপাস এলাকায় কুকুর আছে ২০ থেকে ২৫টি। ওয়াসার মোড় থেকে এমএম আলী রোড হয়ে গোলপাহাড় মোড় পর্যন্ত কুকুর আছে ১৫ থেকে ১৭ টি। পশ্চিম নাসিরাবাদের রহমান নগরে আছে ১০ থেকে ১২টি, আগ্রাবাদের বিশ্বকলোনীতে আছে ২০টিরও বেশি এবং হাজীপাড়ায় কুকুর আছে ১৫ থেকে ২০টি, বিড়াল আছে ৫-৭টি। রাহাত্তারপুল এলাকায় আছে ৩০টি কুকুর এবং ১৫ থেকে ২০ টি বিড়াল, কালামিয়া বাজার এলাকায় কুকুর আছে প্রায় ৪০টি এবং বিড়াল আছে ১০টি, চকবাজার বড়মিয়া মসজিদ এলাকায় কুকুর আছে ৭ থেকে ৮টি। পাঁচলাইশ এলাকার পার্কভিউ হাসপাতালের পাশে আছে ৪টি কুকুর, অক্সিজেনের বালুচরা আবাসিক এলাকায় আছে ১০ থেকে ১৫টি কুকুর এবং বিড়াল আছে ৮ থেকে ৯টি। জিইসি ওআর নিজাম রোডে আছে ৯ থেকে ১০টি কুকুর এবং বিড়াল আছে ৫টি। খুলশী থেকে জিইসি মোড় পর্যন্ত আছে প্রায় ৫০টি। চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা থেকে বহদ্দারহাট কাঁচা বাজার পর্যন্ত রাস্তায় কুকুর আছে ৪৮টি এবং বিড়াল ২১টি। কাজীর দেউড়ি এলাকায় আছে ১৫টি কুকুর। আন্দরকিল্লার ফরহাদাবাগে আছে ১০-১২টি কুকুর। অন্যদিকে হালিশহরে রয়েছে ৫০টিরও বেশি। এছাড়া নগরীর অন্যান্য মোড় বা অলিগলিতে অসংখ্য কুকুর-বিড়াল রয়েছে।

ফেসবুকভিত্তিক ‘অ্যানিমেল কেয়ার অব চট্টগ্রাম’-এর মডারেটর উষা আরও বলেন, ‘এই উদ্যোগে আমিসহ আরো তিন মডারেটর আছেন। তারা হলেন তিশা ভট্টাচার্য, ইয়ানা হক ও সুমী বিশ্বাস। আমরা চার জনই মূলত সবকিছু দেখভাল করছি এবং করবো। এছাড়া আমাদের কিছু স্বেচ্ছাসেবক দরকার। সেই কারণে আমি ফেসবুকে একটি পোস্ট করেছি। সেখানে লিখেছি কার এলাকায় কতটি কুকুর এবং বিড়াল আছে এবং কেউ নিজ এলাকায় কাজ করতে চাইলে সেটাও আমাদের জানাতে বলেছি। এর মাধ্যমে আমি অনেকের সাড়া পেয়েছি। তাদের নিয়ে একটি গ্রুপ খোলা হয়েছে। সেখানেই আমরা সমন্বয় করে কাজ শুরু করবো।’

কর্মপরিকল্পনা জানিয়ে উষা আচার্য্য বলেন, ‘রোববার থেকেই আমাদের কাজ শুরু হবে। আমরা মূলত এই কাজটি করছি বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায়। আমরা নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে রান্নাবান্নার সরঞ্জাম, ডিস্ট্রিবিউশন, গাড়ি ইত্যাদির ব্যবস্থা করছি। চাল-ডালও আমাদেরই সংগ্রহ করতে হবে। তারপর আমরা আমাদের ৫-৬ জন স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে প্রত্যেকটা জায়গায় জায়গায় পাঠিয়ে দেবো। প্রথমত আমরা ৩০০ পশুপ্রাণীর জন্য খাবারের ব্যবস্থা করছি। আস্তে আস্তে বাড়বে। খাদ্য তালিকায় থাকবে খিচুড়ি ও পানি। এর পাশাপাশি আশেপাশে মুড়ি ও বিস্কুট ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হবে যাতে পাখিরা খেতে পারে। খাবার গুলো দেবো আমরা দুপুরবেলা। অন্তত এই দুর্যোগের সময় এই খাবারগুলো খেয়ে পশুপাখিগুলো বাঁচবে। কারণ তারাই তো আমাদের অস্তিত্ব। তাদের জন্যই আজ আমাদের প্রকৃতি এতো সুন্দর। পরিবেশের ভারসাম্য তো তারাই রক্ষা করছে। তারাই যদি খাবারের অভাবে মারা যায় তাহলে তো এসব প্রাণী আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।’

ফিরিঙ্গীবাজার এলাকার রাজিব চক্রবর্তী নামের এক স্থানীয় তরুণ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘পশুপাখিদের প্রতি মনের টান সেই ছোটবেলা থেকেই। যখন কলেজে পড়তাম তখন বাসায় কুকুর পালন করেছিলাম একটি। প্রতিবেলায় নিজে খাওয়ার আগে তাকে খাওয়াতাম। সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতাম। কুকুরের মধ্যেও মানুষের প্রতি ভালোবাসা আছে। এরপর সেই কুকুর মারা যাওয়ার পর একটি বিড়ালও পালন করেছিলাম। কিন্তু নানা কাজে ব্যস্ততার কারণে এখন আর পালন করা হয়ে উঠে না। করোনা ভাইরাসের কারণে লকডাউন হওয়ায় সব কিছু বন্ধ এখন। মানুষ ও আর ঘর থেকে বের হয়না। এই অবুঝ প্রাণীগুলোর কথা চিন্তা করে মনটা কেঁদে উঠল। তাই শুক্রবার ফিরিঙ্গিবাজার মোড়, সুজাকাঠঘর, ইসলামিয়া কলেজ মোড়, সদরঘাটের শাহজাহান হোটেল এসব এলাকায় যে কুকুরগুলো চোখে পড়েছে তাদের আমি খাবার দিয়ে এসেছি।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!