অক্সিজেনের টানাটানিতে ঝুঁকির মুখে জাহাজভাঙা ও ইস্পাত শিল্প

করোনায় হাসপাতালেই এখন অক্সিজেন লাগছে ১৫০ টন

করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সামাল দিতে শিল্প খাতে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করার সরকারি নির্দেশনার পর এখন সরাসরি ঝুঁকির মুখে পড়তে যাচ্ছে দেশের জাহাজভাঙা ও ইস্পাত শিল্প। সংকটের মুখোমুখি হওয়ার প্রহর গুণছে গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানসহ নির্মাণ শিল্পও।

সম্প্রতি দেশে উৎপাদিত সব অক্সিজেনই শিল্প কারখানায় না দিয়ে মেডিকেলে সরবরাহ করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে সরকারের বিস্ফোরক পরিদপ্তর। স্বাভাবিক সময়ে মেডিকেল ও শিল্প মিলিয়ে দেশে অক্সিজেনের চাহিদা প্রতিদিন প্রায় ২২০ থেকে ২৫০ টন। এর মধ্যে মেডিকেল অক্সিজেনের দৈনিক চাহিদা ১০০ থেকে ১২০ টন। সরকারের নতুন নিদের্শনার ফলে মোট উৎপাদনের পুরোটাই ব্যবহৃত মেডিকেলের জন্য। তবে বর্তমানে মেডিকেলে চাহিদা ১৫০ টন ছাড়িয়ে গেছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

এপ্রিল মাসের শুরুতে দেশে হঠাৎ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় দেশের হাসপাতালগুলোতে বেড়ে গেছে অক্সিজেনের চাহিদা। দেশের মোট চাহিদার ২০ শতাংশ অক্সিজেন ভারত থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে ভারতও গত ২১ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশে অক্সিজেন রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। এমন অবস্থায় শিল্প কারখানার অক্সিজেন আপাতত বন্ধ রাখার নিদের্শনা দিয়েছে বিস্ফোরক পরিদপ্তর।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ফরিদ হোসেন বলেন, ‘কিছুদিন আগেও অক্সিজেনের সর্বোচ্চ চাহিদা দাঁড়িয়েছিল ১৫০ থেকে ১৬০ টনে। রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমায় এখন হাসপাতালগুলোতে ১৪০ থেকে ১৫০ টনের মতো অক্সিজেন লাগছে।’

দেশে প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের প্রায় অর্ধেকের যোগান দেয় লিন্ডে বাংলাদেশ। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের শীতলপুরে এই প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কারখানা। প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সরবরাহ বন্ধ করে হাসপাতালে অক্সিজেন সাপোর্ট দিচ্ছি। বর্তমানে দৈনিক ৯০-১০০ টন অক্সিজেন হাসপাতালে দিতে হচ্ছে।’

অক্সিজেন নিয়ে এই টানাটানিতে ঝুঁকির মুখে পড়ে গেছে দেশের দুটি বড় শিল্পখাত— জাহাজভাঙা ও ইস্পাত শিল্প। এই দুই শিল্পের প্রায় পুরোটাই আবার চট্টগ্রামকেন্দ্রিক। ‘রিভিউ অব মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট ২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে বিশ্বের ৫৪.৭ শতাংশ জাহাজ রিসাইকেল করেছে বাংলাদেশ। চট্টগ্রামের সাগর তীরবর্তী উত্তর উপকূল ধরে প্রায় ১২০টি জাহাজভাঙার ইয়ার্ড রয়েছে। এসব ইয়ার্ডে কাজ করেন অন্তত ২ লাখ মানুষ। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বছরে সরকার প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার রাজস্ব পেয়ে থাকে।

অন্যদিকে কেএসআরএম, বিএসআরএম, একেএস, জিপিএইচসহ প্রধান প্রধান ইস্পাত নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সবই চট্টগ্রামভিত্তিক। দেশে ইস্পাতশিল্পের বাজারের আকার এখন প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। দেশের ইস্পাত কারখানাগুলোর মোট কাঁচামালের ৭০ শতাংশই আসে জাহাজভাঙা শিল্প থেকে। জাহাজভাঙা থেকে বের হওয়া ইস্পাতই ইস্পাত কারখানাগুলোর মূল উৎস।

এসব শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অক্সিজেন সরবরাহ না থাকলে বন্ধ হয়ে যাবে ইস্পাত ও রি-রোলিং মিলগুলো। রড উৎপাদনে ওয়েল্ডিং সেকশনে অক্সিজেনের ব্যবহার করতে হয়। এটি না হলে মেশিন আটকে যায় এবং উৎপাদন ব্যাহত হয়। কিন্তু বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে রডের দাম বেড়ে ব্যাহত হবে আবাসন ও কনস্ট্রাকশন কার্যক্রম। অন্যদিকে চেসিস ও পার্টস সংযোজনে অক্সিজেনের ব্যবহার থাকায় সংকটে পড়তে পারে এ শিল্পও। এর ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হুমকিতে পড়ে যাবে কয়েক লাখ শ্রমিকের পেশা।

দেশে ছোট বড় মিলিয়ে চার শতাধিক রি-রোলিং মিল রয়েছে। এর মধ্যে বড় আকারের প্রতিষ্ঠান রয়েছে ২০টিরও বেশি। এসব কারখানায় বছরে ৮০ লাখ টনের বেশি রড উৎপাদন হয়। অক্সিজেন সরবরাহ না থাকলে পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়াই বন্ধ হয়ে যেতে পারে— আশঙ্কা রয়েছে এমনও।

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারিংস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) সেক্রেটারি জেনারেল মো. শহীদুল্লাহ বলেন, ‘স্টিল উৎপাদনের সময় মেশিনের অনেক সেকশন আটকে যায়। ওয়েল্ডিংয়ের সময় ওয়াশিংয়ে অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। প্রতিটি স্টেজ অতিক্রম করার জন্য অক্সিজেন দরকার হয়। যাদের স্টক জমা নেই, তাদের প্রডাকশন এখনই বন্ধ হবে।’

অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের জাহাজভাঙা শিল্প। এ শিল্পের কাজের প্রায় সবই নির্ভর করে অক্সিজেনের ওপর। জাহাজের বড় বড় লৌহখণ্ড ক্রাশিংয়েও অক্সিজেন ব্যবহার করতে হয়। শিল্প মালিকদের মতে, অক্সিজেন না পেলে এদের বেশিরভাগের পক্ষে একদিনও কাজ চালানো সম্ভব নয়। তবে নিজেদের অক্সিজেনের মাধ্যমে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাজ চালিয়ে নিতে পারবে বলে জানান তারা।

জাহাজভাঙা শিল্প এবং ইস্পাত শিল্প ছাড়াও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেনের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল— অটোমোবাইল ও গাড়ির ওয়ার্কশপ। গাড়ির চেসিস-সহ বিভিন্ন পার্টস সংযোজন ও মেরামতে ওয়েল্ডিংয়ে অক্সিজেনের ব্যবহার করতে হয়। অন্যদিকে ইস্পাত শিল্প ঝুঁকির মুখে পড়লে তার প্রভাব পড়বে সরাসরি নির্মাণ শিল্পে।

সিপি

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড অবলম্বনে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!