অকারণ ভিড়ই এখন বিস্ফোরণে পোড়া রোগীদের জন্য বড় ‘বিষফোঁড়া’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

চট্টগ্রামের বিএম কনটেইনার ডিপোর ঘটনায় ‘মানবিক চট্টগ্রামের’ সুনাম সবার মুখে মুখে। নিম্নশ্রেণি থেকে উচ্চশ্রেণির লোকদের মানবিকতায় মুগ্ধ সকলে। চট্টগ্রামের সব পেশার, সব স্তরের মানুষ নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী পাশে দাঁড়িয়েছে রোগীদের।

কিন্তু এখন এই ‘মানবিকতা’ই যেন রোগীদের জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে অমানবিক। পোড়া রোগীদের জন্য ক্ষত যতটা ভয়ের, মানুষের সংস্পর্শ তার চেয়ে বেশি ভয়ের— যা পরবর্তীতে সংক্রমিত হয়ে মৃত্যু ঘটাতে পারে।

শনিবারের (৪ জুন) ঘটনায় আহত বেশিরভাগ পোড়া রোগী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩১, ৩৬ ও ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন। কিন্তু দু’দিন ধরে এই রোগীদের বেডে বাইরের ‘মানবিক’ মানুষদের আনোগোনাই বেড়েই চলেছে।

সরজমিন দেখা যায়, এসব ওর্য়াডগুলোতে রয়েছে সাধারণ মানুষদের অবাধ বিচরণ। কেউ রান্না করা ভাত নিয়ে এসেছেন কেউবা ফলমূল। আবার অনেক নেতাকে দলবল নিয়ে এসে মানবিকতার নামে ফটোসেশান করছেন। সম্প্রতি দেশের জনপ্রিয় ইউটিউবার তৌহিদ আফ্রিদিও নিজের টিম নিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসেন রোগীদের দেখতে। এ সময় তিনি ২০-২৫ জনের একটি বহর নিয়ে ঢুকে পড়েন বার্ন ইউনিটে। যেখানে উনি কোনো ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করা ছাড়াই রোগীদের স্পর্শ করেছেন।

যদিও তিনি রোগীদের সাহায্য করার জন্যই এসেছেন বলে দাবি করেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি কী ধরনের সাহায্য করেছেন তা জানা যায়নি।

সোমবার (৬ জুন) দেশের বড় বার্ন হাসপাতাল শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক ইনস্টিটিউটের প্রধান ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘এই বার্ন রোগীদের একবার ইনফেকশন হয়ে গেলে আর কেউ বাঁচাতে পারবে না। একটা ছোট অগ্নিদগ্ধের ক্ষত অনেক বড় হয়ে যায় ইনফেকশনের কারণে।’

ডা. সামন্ত লাল ছাড়াও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মানবিক মানুষদের উদ্দেশ্যে বলে আসছেন যে, বর্তমানে খাবার এবং ওষধের সংকট নেই। মানিবক মানুষদের হাসপাতালের ভেতর প্রবেশ না করার অনুরোধও করা হয়। কিন্তু তারপরও অনেকে অবাধ্য হয়ে প্রবেশ করছেন হাসপাতালে। স্পর্শ করে দিচ্ছেন সান্ত্বনাও। কিন্তু এই সহমর্মিতা কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে আগুনপোড়া মানুষগুলোর জন্য।

হাসপাতালে উপচেপড়া ভীড় সামলাতে রোববার (৫ জুন) রাত থেকে মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী। তাছাড়া মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরাও আছেন সার্বক্ষণিক। অযথা কাউকে ওয়ার্ডের ভেতর প্রবেশ করতে দিচ্ছে না তারা।

ফাঁড়ির উপপরিদর্শক নুরুল আলম আশিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সাহায্য করতে আসা মানুষদের আমরা বোঝানোর চেষ্টা করছি, তাদের কারণে বার্নের রোগীরা সংক্রমিত হতে পারে। তাই ওখানে না যাওয়াটাই ভালো। অনেকে বুঝছেন আবার অনেকে বুঝেও না বোঝার মতো আচরণ করছেন।’

তিনি বলেন, ‘ওয়ার্ডগুলোতে সাহায্যকারী মানুষের চাপ কমাতে আমরা মেডিকেলের প্রধান ফটকে হেল্পডেস্কের ব্যবস্থা করেছি। যারা রোগীদের বিভিন্ন জিনিসপত্র দিয়ে সাহায্য করতে চান তারা আমাদের হাতে জিনিসগুলো তুলে দিতে পারেন।’

আশিক বলেন, ‘দুর্ঘটনার সময় স্বেচ্ছাসেবকদের দরকার ছিল। কিন্তু বর্তমানে স্বেচ্ছাসেবকদের তেমন কাজ নেই। হাসপাতালের স্টাফদের দিয়েই বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে। কিন্তু স্বেচ্ছাসেবকদের ওয়ার্ডে ঢুকতে নিষেধ করলে তারা আমাদের সঙ্গে তর্ক জড়াচ্ছেন।’

তবে মানবিকতার পেছনেও যে নেতাদের রাজনৈতিক একটি লাভ-লোকসানের ছক আছে সে বিষয়েও ইঙ্গিত করে হচ্ছে আলোচনা-সমালোচনা।

শিগগির হতে যাচ্ছে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কমিটি। আর কমিটিতে পদ পেতে অকারণে অনেকে হাসপাতাল ঘুরে মানবিকতার নামে ফটোসেশন করছেন। হাসপাতালে ভর্তি রোগী ও সঙ্গে থাকা একজন স্বজনকে সরকারিভাবেই খাবার দিয়ে থাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালে যথেষ্ট খাবার রয়েছে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ। এরপরও নিজ উদ্যোগে খাবার নিয়ে হাসপাতালে ঢুকছেন নেতারা।

চট্টগ্রাম মেডিকেলের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান বলেন, ‘আমরা উৎসুক মানুষদের অযথা এসে ভিড় না করার আহ্বান জানাচ্ছি। কিন্তু অনেকে তা শুনছেন না। অন্তত আপনাদের (গণমাধ্যম) মাধ্যমে হলেও তাদের কাছে এই তথ্যটি পৌঁছে দিন। বর্তমানে হাসপাতালে কোনো কিছুর সংকট নেই। তারা যেন অযথা এসে ভিড় না করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আর যদি কখনও কোনো কিছুর প্রয়োজন হয় তাহলে আমরা বলব। অন্তত এখন যাতে ওনারা এসে রোগীদের সংক্রমিত না করে।’

বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেলে সরকারি-বেসরকারি সংগঠন মিলে তিন শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন বলে জানান চট্টগ্রাম যুব রেড ক্রিসেন্টের যুবপ্রধান গাজী মো. ইফতেখার হোসেন ইমু।

ইফতেখার হোসেন ইমু বলেন, আমরা প্রথম দু’দিন ওয়ার্ডগুলোতে সরাসরি যেতাম রোগীদের খাবার, রক্ত বা ওষধ দেওয়ার জন্য। কিন্তু এখন আমরা খুব বেশি দরকার না হলে ভেতরে যাচ্ছি না। আমরা ওয়ার্ডের বাইর থেকেই ওনাদের সাহায্য করছি। কারণ আমরা জানি, আমাদের মাধ্যমে রোগীরা সংক্রমিত হতে পারে। কিন্তু মানবিকতার দেখাতে এক নেতার সঙ্গে ৩০-৪০ জন কর্মীর বহর ওয়ার্ডের ভেতরে প্রবেশ করছে। আর তাতেই রোগীর সংক্রমিত হওয়ার চান্স থাকে বেশি। নেতাদের নিষেধ করলে উল্টো তারা আমাদের শাসিয়ে যান।’

ডিজে/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!