৮ বছর আগে পিটিয়ে ছাত্রহত্যার আসামি সব ছাত্রলীগ নেতাই খালাস

ছাত্রলীগের হাতে ছাত্রাবাসে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদই প্রথম নিহত নন। তারও আট বছর আগে প্রায় একই কায়দায় এই দলের নেতাদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ হারান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) শিক্ষার্থী আবিদুর রহমান। ওই ঘটনায় আবিদের পরিবার মামলা দায়ের করে। অভিযোগ উঠছে, মামলার বাদিকে আদালতের কাছেও ঘেঁষতে দেয়নি আসামিপক্ষ। বাদির অনুপস্থিতিতে আদালতে হত্যার উপযুক্ত কোন নথি উপস্থাপিত না হওয়ায় মামলা থেকে খুনে অভিযুক্তরা খালাস পান।

নিহত আবিদ চমেকে বিডিএস তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। আবিদ ছিলেন কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার উত্তর বড়ইতলী গ্রামের মৃত নুরুল কবির চৌধুরীর কনিষ্ঠ ছেলে।

আবিদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তার মামা নেয়ামত উল্লাহ বাদি হয়ে ছাত্রলীগের ২২ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ ১২ জনের নামে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। গত ১০ জুলাই চট্টগ্রাম পঞ্চম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ জান্নাতুল ফেরদৌস মামলার বিচার শেষে রায় ঘোষণা করেন। রায়ে লেখা হয়, ‘মফিজুর রহমান গংদের অত্র মামলার দায় হইতে খালাস প্রদান করা হইল।’

রায়ের বিষয়টি শুনে আবিদের ভাই জিল্লুর রহমান হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, ‘সব কিছু থেকে আমাদের অন্ধকারে রাখা হয়েছে। ২০১২ সালে পুলিশ ১০ জনকে চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়ার পর চার্জশিটের বিরুদ্ধে আমরা নারাজি দিতে চেয়েছিলাম। আসামিপক্ষ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তা করতে দেয়নি। মামলার বাদি আমার মামাকে আদালতে উপস্থিত হয়ে সাক্ষ্য দিতেও তারা দেয়নি। মামলাটি ছিল চট্টগ্রাম প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে। রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মামলাটির কোর্ট পরিবর্তন করে সাক্ষীদের অনুপস্থিতিতে রায়ের পর্যায়ে নিয়ে আসতে সহায়তা করেছে।’

তবে বাদিপক্ষের অভিযোগের বিষয়টি অস্বীকার করে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি এডভোকেট অশোক কুমার দাস বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ যথেষ্ট চেষ্টা করেছে আসামিদের দোষী প্রমাণ করতে। মামলার সাক্ষীরাও সাক্ষ্য দিয়েছেন। কিন্তু জেরা-পাল্টা জেরায় শেষ পর্যন্ত অভিযুক্তরা দোষী প্রমাণ না হওয়ায় আদালত তাদের খালাস দিয়েছে। বাদিকে মামলার তারিখে আদালতে হাজির রাখতে আমি নিজে যোগোযোগ করেছি। কিন্তু উনি উপস্থিত হননি। এখন উচ্চ আদালতে আপিল করলেও রাষ্ট্রপক্ষ তাদের পক্ষে থাকবে।’

রায়ের বিষয় জেনে আবিদের আত্মীয় এডভোকেট রেদোয়ানুল হক শাকিল চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এই রায়ের বিরুদ্ধে আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করবো। আদালত থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র উত্তোলন করে হাইকোর্টের ছুটি শেষ হলেই আমরা আপিল করবো।’

উল্লেখ্য, মামলার এজহারভুক্ত আসামি ছিলেন চমেক ছাত্র সংসদের ভিপি মফিজুর রহমান জুম্মা, চমেক ছাত্রলীগ সভাপতি সোহেল পারভেজ সুমন, সাধারণ সম্পাদক বিজয় সরকার, চমেক ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক হিমেল চাকমা, ফেরদৌস রাসেল, শান্ত দেব নাথ, রাশেদুর রহমান সানি, দেবাশীষ চক্রবর্তী, সালমান মাহমুদ সিদ্দিকী রাফসান, মাহফুজুর রহমান দিমান, মোস্তফা কামাল, নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারী, ইশতিয়াকুল ইসলাম খান, ওহিদুর রহমান, রাশেদুল ইসলাম, নাভিদ আঞ্জুম তানভির, আসিফ কামাল, ইরফানুল হক শুভ, সিরাজুল আমিন, এসএম হারুনুর রশিদ, মিনহাজুর রহমান এবং সাইফুল আমিন। এদের প্রত্যেকেই কেউ চমেকের তৎকালীন ছাত্রলীগের নেতা, আবার কেউ ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত ছাত্র সংসদের নেতা ছিলেন।

মফিজুর রহমান জুম্মা, সোহেল পারভেজ সুমন, বিজয় সরকার, হিমেল চাকমা, ফেরদৌস রাসেল, শান্ত দেবনাথ, মাহফুজুর রহমান, নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারী, দেবাশীষ চক্রবর্তী, মোস্তফা কামাল, রাশেদুর রহমান সানি ও সালমান মাহমুদ রাফসানকে অভিযুক্ত করে পুলিশ অভিযোগপত্র দাখিল করে আদালতে। এজাহারভুক্ত বাকি ১০ আসামিকে অভিযোগপত্র থেকেই অব্যাহতি দেয় পুলিশ।

আবিদের বন্ধুদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আবিদ ছাত্রদলকে গোছাতে সক্রিয় ছিলেন। কারণ তখন ছাত্রদলের চমেক কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল। যা সহ্য করতে পারেননি চমেক ছাত্রলীগের নেতারা। তাকে ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর দুপুর ২টা, সন্ধ্যা ৭টা ও রাত ১০টায় তিন দফা নির্যাতন করে। নির্যাতনের পর সুযোগ না দিয়ে আবিদকে তার বোনের বাসায় পাঠিয়ে দেয়। যা আবিদ হত্যা মামলার এজাহারেও উল্লেখ আছে।

চার বোন তিন ভাইয়ের সাবার ছোট ছিল আবিদ। চকরিয়া উপজেলার বড়ইতলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে তিনি চমেকে ভর্তি হয়েছিলেন। আবিদ মেজ বোন মোরশেদা ইয়াসমিন, ছোটবোন রায়হান জান্নাত আর বড় বোন সাজেদা ইয়াসমিনের ছেলে শাফকাতকে নিয়ে নগরীর চকবাজার এলাকার ডিসি রোডে বসবাস করতেন। মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর আবিদ ছাত্রাবাসে উঠেন। কিন্তু বাসা ছাড়েননি। এরই মাঝে মেজ বোনের বিয়ে হলে তিনিও পাশাপাশি বাসা নিয়ে বসবাস করতেন। আবিদ মারা যাওয়ার পর তার আরেক বন্ধুকে দিয়ে তার লাশ ছাত্রলীগ নেতারা মেজ বোনের বাসায় পাঠায়।

সেদিনের স্মৃতি হাতড়ে আবিদের মেজ বোনের স্বামী কামরুল হাসান সোহেল চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘১৯ অক্টোবর ২০১১ আমার শ্বশুর বাড়ি এলাকার সালমান নামের এক শিক্ষার্থীর মাধ্যমে আবিদকে ছাত্রলীগ বাসায় পাঠায়। সালমান ভয়ে কথা বলতে পারছিলোনা। শুধু বলেছিল, আবিদকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে। আমরা দেখলাম তার গায়ে আঘাতের চিহ্ন আছে। তখন চমেক হাসপাতালে নিয়ে যাই। ছাত্রলীগ মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে দেয়নি। পরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিই। সেখান থেকে আবার চমেক রেফার করে। দুই দিন অজ্ঞান থাকার পর ২১ অক্টোবর আবিদকে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!