আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, তার পরিবারের সদস্য ও পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের ৭৭টি ব্যাংক একাউন্ট ‘অবরুদ্ধ’ করার আদেশ দিয়েছে আদালত। এই একাউন্টগুলোতে সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। এসব ব্যাংক হিসাবে এখন মাত্র ২৪ কোটি ৬৬ লাখ ৪১ হাজার ৯৫৮ টাকা জমা আছে।

বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ জাকির হোসেন গালিব এ আদেশ দিয়েছেন।
ব্যাংক একাউন্টগুলোর মধ্যে হাছান মাহমুদের ৮টি, তার স্ত্রী নুরান ফাতেমার ১৪টি, মেয়ে নাফিসা জুমাইনা মাহমুদের ৬টি, হাছান মাহমুদ ও স্ত্রীর যৌথ একাউন্ট রয়েছে ৩টি।
এছাড়া হাছান মাহমুদ পরিবারের বিসমিল্লাহ মেরিন সার্ভিসের ৩৪টি, বিসমিল্লাহ মেরিন সার্ভিসেস ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড হোল্ডিংসের ৬টি, অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশ সোলার পাওয়ার লিমিটেডের ৩টি, সুখি বাংলা ফাউন্ডেশনের ২টি ও বিসমিল্লাহ মেরিন সার্ভিস জেএএস লিমিটেডের একটি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনে বলা হয়েছে, হাছান মাহমুদ, তার স্ত্রী-কন্যা ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক হিসাবে ৭৫৩ কোটি ৩০ লাখ ২৭ হাজার ৫৫৯ টাকা লেনদেন হয়েছে, যা সন্দেহজনক। প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে হাছান মাহমুদ ও তার পরিবার এসব লেনদেন করেছেন, যাতে অর্থপাচারের সম্ভবনা অনেক বেশি।
এর আগে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই হাছান মাহমুদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
জামার্নিতে রোষের মুখে
গত ১৯ ডিসেম্বর বেলা ২টায় জার্মানির কোলনের উলিথজক্যাস্টরে আওয়ামী লীগের এক সভায় গিয়ে নেতাকর্মীদের রোষের মুখে পড়েন হাছান মাহমুদ। হাছান মাহমুদ অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হওয়ার পরপরই স্থানীয় নেতাকর্মীদের একটি দল তার দিকে তেড়ে গিয়ে আওয়ামী লীগের বর্তমান দুর্দশা ও দুর্নীতির অন্যতম কুশীলব হিসেবে সরাসরি তাকে দায়ী করেন। গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর এই প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাধর এই সাবেক মন্ত্রীকে জনসমক্ষে দেখা যায়।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, সভাস্থলে পৌঁছার পর হাছান মাহমুদ কুশলবিনিময় করার একপর্যায়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এ সময় হাছান মাহমুদকে উদ্দেশ্য করে কয়েকজন বলেন, ‘আপনি কোনো কথা বলবেন না। আপনার মতো কয়েকজন নেতার কারণে আওয়ামী লীগের আজকে এই দুরবস্থা। চুপচাপ গিয়ে মঞ্চে বসে থাকুন।’ সভায় উপস্থিত অন্য একজন সাবেক এই মন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘কেন আপনি বেলজিয়াম থেকে জার্মানি এসেছেন? এখানে আপনার কাজ কী? আওয়ামী লীগকে আপনারাই ডুবিয়েছেন।’
বার্লিন থেকে যাওয়া এক নেতা হাছান মাহমুদের সামনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আপনাদের লোভ আর দুর্নীতির কারণেই দেশে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মিরা আজকে দুর্বিসহ জীবন কাটাচ্ছে। হুমকির মুখে আছে সবার জীবন। আহত নিহত নেতাকর্মীদের কোনো খোঁজখবর আপনি রাখেন নাই। যাকে ইচ্ছা তাকে দলে ঢুকিয়েছেন। আপনাদের দুর্নীতির কারণে দল আজ বিপর্যস্ত, দিশেহারা।’
এর আগে ইউরোপ আওয়ামী লীগের এক নেতা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানিয়েছিলেন, হাছান মাহমুদ বেলজিয়াম থেকে একাধিকবার দিল্লিতে অবস্থানরত দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। দলীয় সভানেত্রী তার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। এমনকি সভানেত্রীর সঙ্গে দেখা করতে দিল্লি আসতে চেয়েও অনুমতি পাননি।
ঢাকা ছেড়ে পালান ২৫ আগস্ট
আটক হওয়ার পরও হাছান মাহমুদ কিভাবে বাংলাদেশ ছাড়তে সক্ষম হলেন— এ নিয়ে গত কয়েকমাস ধরে জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম হয়েছে।
শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পরদিন ৬ আগস্ট বিকেলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদকে ঢাকা বিমানবন্দরে আটক করা হয়েছে বলে বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্র বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে নিশ্চিত করে। এরপর থেকে তিনি সেনা হেফাজতে আছেন— এমন খবর বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া গেলেও পরে নিশ্চিত হওয়া যায়, গত ২৬ আগস্ট সন্ধ্যায় (বেলজিয়াম সময়) হাছান মাহমুদ নিরাপদে বেলজিয়ামে পৌঁছেছেন। বেলজিয়ামে তিনি লিমবুর্গ প্রদেশের হ্যাসেল্ট সিটিতে তার নিজের বাড়িতেই আছেন।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, গত ২৫ আগস্ট হাছান মাহমুদ বাংলাদেশ ছাড়েন। ২৬ আগস্ট রাতে তিনি জার্মান বিমানবন্দরে পৌঁছান। এরপর ডুসেলডর্ফের একটি রেস্টুরেন্টে যান খাবার খেতে। সেখান থেকে বেলজিয়ামের উদ্দেশ্যে রওনা হন। সীতাকুণ্ডের বাসিন্দা জার্মান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোবারক আলী ভূঁইয়া বকুল এ সময় তাকে সঙ্গ দেন।
এর আগে ৪ আগস্ট রাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের পরিবারের সদস্যরা ইকে ৫৮৬ নম্বর ফ্লাইটযোগে দেশ ছাড়েন। তাদের গন্তব্য ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই বিমানবন্দর। তবে তার পরিবারের সদস্যরা অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে থাকেন।
পুরনো ডেরা বেলজিয়াম
হাছান মাহমুদ দীর্ঘদিন বেলজিয়ামে বসবাস করেছেন। সেখানে তার ছোট ভাই স্থায়ীভাবেই থাকেন। দুবাই, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্য ছাড়াও বেলজিয়ামে তিনি বিপুল অংকের টাকা পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ১৯৯২ সালের দিকে প্রথম বেলজিয়াম যান হাছান মাহমুদ। সেখানে তিনি বেলজিয়ামের ব্রিজ ইউনিভার্সিটি অব ব্রাসেলস ও লিম্বুর্গ ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনাও করেছেন। ২০০১ সালে দেশে ফিরে তিনি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী হিসেবে যোগ দেন। এরপর থেকে তার ভাগ্য খুলে যায়।
পরবর্তীতে তিনি ২০০৯ সালের মহাজোট সরকারের প্রথম ছয় মাস পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং পরে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে তার বিরুদ্ধে জলবায়ু তহবিলের বিপুল অংকের টাকা লুটপাটের অভিযোগ ওঠে। শেখ হাসিনার চতুর্থ মন্ত্রিসভায় তিনি তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। সর্বশেষ তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালে হাছান মাহমুদের নির্দেশে চট্টগ্রাম প্রতিদিনসহ ভিন্নমতের বহু সংবাদপত্র ও অনলাইন একাধিকবার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তার সময়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা অবর্ণনীয় হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন। গত দেড় বছরে অন্তত ২০০ জন সাংবাদিককে নির্যাতন ও হয়রানি করা হয়েছে বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়। এজন্য প্রধানত হাছান মাহমুদকে দায়ী করা হয়ে থাকে। এ সময়ে বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দাঁড়ায় ১৬৫তম স্থানে। গত ১৫ বছর ধরে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় তার নির্বাচনী এলাকায় বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-নির্যাতন, মামলা দিয়ে তাদের হয়রানি করে চরম ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন হাছান মাহমুদ।
সিপি