৬ দিনে ৯, শিশু থেকে বৃদ্ধ— খুনোখুনি বাড়ছে চট্টগ্রামজুড়ে

খুনের ঘটনা বাড়ছে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামে গত ৬ দিনে খুন হয়েছে ৯ জন। কিছু ক্ষেত্রে তুচ্ছ ঘটনায় হয়ে যাচ্ছে খুনোখুনি, পারিবারিক কলহ থেকে প্রতিহিংসায় নীল হয়ে হত্যা করছে নিজের পরিবারের সদস্যকেই। প্রতিদিনই ঘটছে কোন না কোন প্রতিহিংসা ও নির্মমতার ঘটনা— পরিকল্পিত হত্যা, রাজনৈতিক হত্যা, পারিবারিক বিবাদে হত্যা। সম্প্রতি সবচেয়ে নির্মম হয়ে দৃশ্যমান হলো পিতামাতার হাতে শিশু সন্তানের মৃত্যু।

খুনের ঘটনায় আইন-শৃংখলা বাহিনীর দায়িত্বশীল তৎপরতা লক্ষ্য করা গেলেও অপরাধীদের শাস্তির ভীতি কমে যাচ্ছে। এর কারণ বিভিন্নমুখী সামাজিক প্রভাব, মানুষের চিন্তার বিকৃতি, অস্থির মানসিক অবস্থায় তীব্র প্রতিহিংসা প্রদর্শন করা,আইনের প্রতি আস্থা না থাকা, দাম্পত্য সম্পর্কে শ্রদ্ধা ও বোঝাপড়ার অভাব অপরাধপ্রবণতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে—এমন মতামত ব্যক্ত করেছেন সমাজ ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা।

সীতাকুণ্ডে যুবক খুন
সর্বশেষ মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) এজাহার মিয়া নামের এক যুবকের মৃত্যু হয় সীতাকুণ্ডে। ১৭ অক্টোবর সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়তলী থানার রাণী রাসমনির ঘাট সংলগ্ন এলাকায় ভগ্নিপতির মোবাইল চুরিকে কেন্দ্র করে নির্যাতন চালায় এসআই ইকবাল পারভেজ। ওই নির্যাতনে এজাহার মিয়ার মৃত্যু হয়েছে বলে পরিবারের অভিযোগ।

হাটহাজারীতে কাঠমিস্ত্রির ঝুলন্ত লাশ
মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) সকালে হাটহাজারীতে আনিসুর রহমান নামের এক কাঠমিস্ত্রির ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। সে ফতেপুর ইউনিয়নের নওশে পাড়ার রিক্সাচালক আবুল মনসুরের ছেলে। বাবার অভিযোগ তাকে কেউ হত্যার পর লাশ ঝুলিয়ে দিয়েছে।

আনোয়ারায় অজ্ঞাত লাশ
উপজেলার জুইদণ্ডী ইউনিয়নের গোদার গোড়া এলাকায় শঙ্খ নদীতে দুদিন ধরে ভাসছিল ৩৫ বছর বয়সী অজ্ঞাত এক যুবকের লাশ। মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) দুপুরে আনোয়ারা থানা পুলিশ লাশটি উদ্ধার করে। লাশটির পরিচয় এখনো জানা যায়নি।

সীতাকুণ্ডে গৃহবধূর মৃত্যু
সোমবার (২১ অক্টোবর) বিকাল সাড়ে চারটার দিকে সীতাকুণ্ড পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের প্রেমতলা এলাকায় স্বামীর সাথে অভিমান করে গলায় ফাঁস খেয়ে মিতা দেবী (২১) নামের এক বাকপ্রতিবন্ধী গৃহবধূ মারা গেছে এমন সংবাদ প্রকাশিত হলেও মৃত্যুটি রহস্যজনক বলছে পুলিশ।

মায়ের হাতে শিশুকন্যা ও স্বামী খুন
শনিবার (১৯ অক্টোবর) নগরীর বন্দর থানায় পরকীয়া প্রেমের জেরে মা হাসিনার হাতেই খুন হয় শিশুকন্যা ফাতেমা বেগম (৪) ও শিশুর বাবা আবু তাহের (৩৫)।হাসিনা বেগম ও তার কথিত প্রেমিক মহিন উদ্দিন গ্রেপ্তার হলেও এ ঘটনায় দেশে তোলপাড় হয়েছে।

সদরঘাটে তরুণ খুন
শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) তুচ্ছ বাকবিতণ্ডার জেরে খুন হয়েছিলেন সদরঘাট থানার পশ্চিম মাদারবাড়ির হেলাল উদ্দিন (১৮)। সাবলেট থাকা দুই পরিবারের বাকবিতণ্ডার জেরে অকস্মাৎ ছুরি চালিয়ে দেন হেলাল উদ্দিনের বুকে। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়েছিলো।

চট্টগ্রাম বন্দরে সার্জেন্ট খুন
বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে ঢাকামুখী মহাসড়কে সংযোগ সড়কে (টোল রোড) কাভার্ড ভ্যানের চাপায় হত্যা করা হয় নগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত ট্রাফিক সার্জেন্ট মোহাম্মদ আবদুল্লাহকে (৩০)। পরিবারের দাবি তাকে পরিকল্পিতভাবেই হত্যা করা হয়েছে।

সীতাকুণ্ডে চিকিৎসক খুন
বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) রাতে সেইফ লাইনে শহরে আসার জন্য গাড়িতে উঠে নিখোঁজ হন ডাক্তার শাহ আলম। একই দিন সীতাকুণ্ডের ছোট কুমিরা এলাকায় একটি অজ্ঞাত লাশ পায় পুলিশ। পরে পুলিশ জানতে পারে লাশটি নিখোঁজ হওয়া ডা. শাহ আলমের। এ ঘটনায় জড়িত মুনছর পরিবহনের ড্রাইভার ওমর ফারুককে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। ছিনতাইকারীদের হাতেই তিনি খুন হয়েছিলেন।

চন্দনাইশে বৃদ্ধ খুন
চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলায় এলাকার লোকজনের সঙ্গে শঙ্খ নদীতে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফেরত আসেননি আমজু মিয়া নামে ৫৫ বছর বয়সী এক ব্যবসায়ী। ছেলে আলমগীর হোসেনের ধারণা তার বাবা যাদের সঙ্গে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন তারাই তাকে খুন করে লাশ গুম করেছে।

অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি ও সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া নৃশংস খুনের ব্যপারে প্রশ্ন করলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার মাহবুবর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘কোথায় কি ঘটনা ঘটবে সেটি আগেভাগে জেনে ফেলা কঠিন, অনেকটা অসম্ভব। পারিবারিক শত্রতায় ঘটে যাওয়া হত্যা সম্পর্কে আঁচ করা সম্ভবও নয়। কিন্তু ঘটনা ঘটে যাবার পর পুলিশ কত দ্রুত অ্যাকশন নিতে পেরেছে সেটিই দেখার বিষয়। আমরা খুব দ্রুতই কয়েকটি ঘটনার রহস্য উন্মোচন করে আসামিও গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি।’

তিনি আরো বলেন, ‘তবে অপরাধ প্রবণতা রোধের জন্য আসলে প্রত্যেক পরিবারকে একটি ইউনিট হিসেবে কাজ করতে হবে। অপরাধী না হওয়ার শিক্ষা আসতে হবে ঘর থেকেই।সহিষ্ণুতা, শ্রদ্ধাবোধ এগুলো শিক্ষার ভিত হওয়া প্রয়োজন ছিলো অথচ তেমন খুব কম চোখে পড়ে।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)ও সুশাসনের জন্য নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রাম মহানগরীর সভাপতি অ্যাডভোকেট আকতার হামীদ বলেন, ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতিও মানুষের মনে প্রতিহিংসা বৃদ্ধি করেছে। হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা প্রতিশোধ প্ররণতা। এগুলো অপরাধের মৌলিক নিয়ামক। এসব কারণেও মানুষ বিচার হাতে তুলে নিচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব অবহেলার কারণে অপরাধ বাড়ছে। অপরাধ করে অপারাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে তাই অপরাধী বাড়ছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ক্রিমিনোলজি (অপরাধ-পুলিশ সাইন্স) বিভাগের চেয়ারম্যান ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘যেগুলোকে অপরাধ বলা হয় সেগুলো অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে একটি কারণ সামজিক বৈষম্য, ধনী-গরীবের বৈষম্য। কেউ অতিমাত্রায় অবৈধ সম্পদ অর্জন করছে। এতে ক্ষুব্ধ হয়েছে অন্যপক্ষ।এভাবেও সমাজে অপরাধ দানা বাঁধে। শুধু সামাজিক কারণে মানুষ অপরাধী হয় না।

তিনি আরো বলেন, শুধু সামাজিক কারণগুলোই অপরাধ বৃদ্ধির মৌলিক কারণ নয়। এতে অনেক প্রভাবক কাজ করে। অপরাধ রুখতে যাকে তার জায়গা থেকে কাজ করে যেতে হবে।

এএস/এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!