৫ কোটি টাকার ওভারটাইমে ১০৪ ঘণ্টার তালগোল চট্টগ্রাম ওয়াসায়

বেতনের চেয়ে ওভারটাইমে ১ কোটি বেশি বরাদ্দ

চট্টগ্রাম ওয়াসায় ওভারটাইম নিয়ে চলছে আজব নীতি। প্রতিষ্ঠান থেকে একজনের জন্য ওভারটাইমের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ১০৪ ঘণ্টা। অর্থাৎ কেউ এর বেশি কাজ করলেও টাকা পাবেন ১০৪ ঘণ্টার। তবে এই ফাকে অনেকে কম সময় কাজ করেও হাতিয়ে নিচ্ছে ১০৪ ঘণ্টার টাকা। সুযোগ কাজে লাগিয়ে উপরি টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন একশ্রেণির কর্মচারী।

যারা বাস্তব অর্থে ১০৪ ঘণ্টার বেশি কাজ করছে তারা বঞ্চিত হচ্ছে বাড়তি কাজের টাকা থেকে। অনেকে কাজ না থাকার পরও প্রতিষ্ঠান ও শ্রমিক ইউনিয়নের অফিসে বসে অলস সময় পার করে ঘণ্টার হিসেব তুলছে ওভারটাইমের খাতায়। এসব বিষয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই ওয়াসা কর্তৃপক্ষের।

প্রতিবছর যেখানে কর্মচারীদের বেতন বাবদ ৪.১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ সেখানে ওভারটাইমের জন্য ওয়াসা ব্যয় করে ৫.১৯ কোটি টাকা।

তবে ১০৪ ঘণ্টার বেশি কাজ করেও বাড়তি ওভারটাইম না পাওয়ার কারণ হিসেবে ওয়াসার কর্মকর্তাদের দাবি, খরচ কমানোর জন্য এটা করা হয়েছে। তবে পিক আওয়ারে কাজ না করে অফটাইমে কাজ দেখিয়ে ওভারটাইম বাড়ানো তাদের চোখে ‘দোষের’ কিছু না।
 
জানা গেছে, চট্টগ্রাম ওয়াসার শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার ও মডিউল ১, ২, ও ৩-এ কর্মরত পাম্প অপারেটর, ইলেক্ট্রিশিয়ান, সহকারী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, ল্যাবরেটরি সহকারীরা বেতনের চেয়ে দ্বিগুণ টাকা ওভারটাইম হিসেবে দেখিয়ে তুলে নিচ্ছেন বছরের পর বছর।

চট্টগ্রামের মড-১ আগ্রাবাদ বাদামতল এলাকার মড-১ এর আওতাধীন ১২টি পাম্প রয়েছে। এখানে  নির্বাহী প্রকৌশলী ১ জন, সহকারী প্রকৌশলী ২ জন, উপ-সহকারী প্রকৌশলী ৪ জন, সুপারভাইজার পদ শূন্য, কার্য সহকারী ২ জনের জায়গায় কর্মরত ১ জন, পাইপ লাইন সুপারভাইজার ২ জনের মধ্যে ১ জন, প্লাম্বিং মিস্ত্রি ২ জন, সহকারী প্লাম্বিং মিস্ত্রি বা এপিএম ৩ জন, ফোরম্যান ১ জন কর্মরত আছেন। পর্যাপ্ত লোকবল থাকার পরও এখানকার অনেকে ওভারটাইমের নামে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।

চট্টগ্রাম ওয়াসার মড-১ আগ্রাবাদ বাদামতল অফিসের এলএমএসএস পান নাহার। ৬ মাস পর অবসরে যাবেন তিনি। পিয়ন হিসেবে ২০ বছর চাকরি করার পর তিনি ২০তম গ্রেড থেকে ১৮তম গ্রেডে এপিএম হয়েছেন। কর্মঘণ্টার বাইরে প্রতিদিন ৪ ঘণ্টা ওভারটাইম করেন তিনি। এমনকি শুক্র এবং শনিবারও করেন অফিস। কিন্তু পান নাহার বয়সের ভারে ও শারীরিক অসুস্থায় ভারী কোনো কাজ করতে পারেন না। শুধুমাত্র এক রুম থেকে আরেক রুমে ফাইল নিয়ে যান।

এরপরও সব মিলিয়ে মাসে তিনি ১২০ থেকে ১২৫ ঘণ্টার ওভারটাইম করে থাকেন। তবে কর্মঘণ্টার বাইরে তাকে দিয়ে ওভারটাইম করানোর দরকার নেই বলে জানিয়েছে খোদ অফিস কর্তৃপক্ষ।

এই মডের আরেকজন পাম্প অপারেটর মো. লোকমান। সেখানে তার সর্বসাকুল্যে ৮০ ঘণ্টা ওভারটাইম হলেও তিনি ওভারটাইম বাড়াতে সংশ্লিষ্ট মডের নির্বাহী প্রকৌশলীকে ম্যানেজ করে প্লাম্বার মিস্ত্রির কাজ করেন। এতে তার ওভারটাইম আসে ১১৫ ঘণ্টার মতো।

আরও জানা গেছে, চট্টগ্রাম ওয়াসার মডগুলোতে যেসব কর্মচারী রয়েছে তারা দিনের বেশিরভাগ সময় চট্টগ্রাম ওয়াসা কার্যালয়ের সিবিএর অফিসে বসে অলস সময় পার করেন। সারাদিন গ্রাহকদের নানা অভিযোগ আসলেও তা আমলে নিয়ে সন্ধ্যার পর যান সমাধান করতে।

চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাট, চান্দগাঁও, বাকলিয়া আর খাতুনগঞ্জ নিয়ে গঠিত হয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসার মডিউল-৩। শুরুতে এসব এলাকায় পানি সরবরাহের জন্য ছিল মোট ৩৯টি পাম্প। কিন্তু এর মধ্যে বর্তমানে চালু আছে মাত্র তিনটি, বাকি ৩৬টি বন্ধ রয়েছে ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে। বন্ধ হয়ে গেলেও ওয়াসা কর্তৃপক্ষ এসব পাম্প থেকে কর্মীদের প্রত্যাহার করেনি। বন্ধ এসব পাম্পেও কর্মচারীরা নিয়মিত বেতনতো বটেই, সঙ্গে নিচ্ছেন ওভারটাইমও।

এছাড়া বহাদ্দারহাটের চট্টগ্রাম ওয়াসার বুস্টার স্টেশনের ইলেক্ট্রিশিয়ান আক্কাস প্রতি মাসেই ১২০ ঘণ্টার বেশি ওভারটাইম করে থাকেন। প্রতিদিন তিনি কর্মঘণ্টার বাইরে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা স্টেশনে বসে অলস সময় পার করেন। এমনকি অফিস চলাকালীন সময়েও তিনি অলস বসে থাকেন। এরপরও তিনি ওভারটাইম করেন।

মড-৩ এর পাম্প অপারেটর মো. জাকারিয়া কর্মঘণ্টার বাইরে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা ওভারটাইম করে থাকেন। এই বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘পাম্প না চললেও আমাকে বসে থাকতে হয় মডে।’

কেন বসে থাকতে হয়–এইপ্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটা আসলে হয়ে আসছে। পাম্প চালু অবস্থায় কাজের চাপ বেশি ছিল। অনেক সময় চালু পাম্পগুলোতেও আমাকে পাঠানো হয়। আমাকে ওভারঅল প্রস্তুত রাখা হয়, পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম ওয়াসার একাধিক কর্মচারী অভিযোগ করে জানান, কর্মরত গাড়ি চালকদের সাধারণত নির্ধারিত কর্মঘণ্টায়ও বেশিরভাগ সময় কাজ করতে হয় না। কিন্তু কর্মরত নির্বাহী প্রকৌশলীদের প্রতি মাসে নগদ ৫ হাজার টাকা ও ৩৫ লিটার পেট্রোল ঘুষ দিয়ে মাসে অতিরিক্ত ১৪০ ঘণ্টা পর্যন্ত ওভারটাইম লিখিয়ে নেন। এতে একজন চালকের মাসিক বেতন দাঁড়ায় প্রায় ৫০ হাজার টাকার কাছাকাছি।

এদিকে মাসে ১৩০ ঘণ্টা বেশি কাজ করেও নির্ধারিত ১০৪ ঘণ্টার ওভারটাইম প্রসঙ্গে ক্ষোভ ঝেরে কয়েক কর্মচারী বলেন, ‘আমরা যারা দিন-রাত খেটে ওয়াসার জন্য কাজ করি, তাদের ওভারটাইম কাটা সত্যিই অমানবিক। কেউ কাজের সময় কাজ না করে অসময়ে কাজ করে ওভারটাইমের পাল্লা ভারী করে, আর আমরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ন্যায্য পাওনা পাই না।’

এসব বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম ওয়াসার মড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী ইফতেখারুল্লা মামুন বলেন, আমি এই মডে বছরখানেক আগে যোগদান করেছি। আমি আসার পর কর্মচারীদের ওভারটাইমে বেশ কড়াকড়ি আরোপ করেছি। ১০৪ ঘণ্টার বেশি ওভারটাইম আমরা নথিভুক্ত করতে দিচ্ছি না। এতে আমাদের কর্মচারীদের তোপের মুখেও পড়তে হচ্ছে। তবে আমাদের বিরুদ্ধে যেসব বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে, তা ঠিক না।’

এই ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী একেএম ফজলুল্লাহ বলেন, ‘এখন ওয়াসায় ১০৪ ঘণ্টার বেশি ওভারটাইম করার সুযোগ নেই।শ্রমিক-কর্মচারী নাখোশ জেনেও আমরা ওয়াসাকে বাঁচাতেই আয়ের সঙ্গে মিল রেখে শ্রমিকদের কম ওভারটাইম দিচ্ছি।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm