৫৫ পেরিয়ে ৫৬ বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, গৌরবের পাশে আছে বঞ্চনার বোঝা

স্বাধীনতা লাভের মাত্র অল্প কয়েক বছর আগে যাত্রা শুরু করা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ৫৫ বছর পেরিয়ে পা দিয়েছে ৫৬ বছরে। দীর্ঘ এই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাপ্তির ঝুড়ি যেমন অনেকটা পূর্ণ হয়েছে, তেমনই কিছু অপ্রাপ্তির বোঝা এখনও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আয়োজন করেছে বর্ণিল অনুষ্ঠানমালার। যার মধ্যে রয়েছে র‍্যালি, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, কেক কাটা, আলোচনা সভা, স্মৃতিচারণ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর চারটি বিভাগ নিয়ে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় যাত্রা শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়টি। শিক্ষার্থী সংখ্যার দিক দিয়ে এটি তৃতীয় বৃহত্তম এবং আয়তনে দেশের সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয় এটি।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ৯টি অনুষদের অধীনে ৪৮টি বিভাগ ও ৭টি ইনস্টিটিউট রয়েছে। এতে শিক্ষার্থী আছে প্রায় ২৮ হাজার ও নয় শতাধিক শিক্ষক। আরও রয়েছে চার লক্ষাধিক বইয়ের বিশাল সংগ্রহশালা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে তিনটি ভিন্নধর্মী নিজস্ব জাদুঘর। এছাড়া শিক্ষার্থী পরিবহনের জন্য আছে নিজস্ব শাটল ট্রেন।

৫৫ পেরিয়ে ৫৬ বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, গৌরবের পাশে আছে বঞ্চনার বোঝা 1

পাহাড়ঘেরা এই ক্যাম্পাসে বসবাস করছে ৩০৮ প্রজাতির বন্যপ্রাণী। এর মধ্যে পাখি রয়েছে ২১৫ প্রজাতির। ব্যাঙ রয়েছে ১৭ প্রজাতির, সরীসৃপ ৫৬ প্রজাতির ও স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে ২০ প্রজাতির। এছাড়াও আছে আড়াই শ’ প্রজাতির বৃক্ষের সংগ্রহ।

মহান মুক্তিযুদ্ধে চবির ১৫ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী তাদের জীবন বিলিয়ে নিজেদের ত্যাগের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মো. হোসেন পেয়েছেন বীরপ্রতীক খেতাব। এছাড়া ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৯০’র স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ দেশের ক্রান্তিলগ্নে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল দৃঢ়চেতা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্ব বিকাশে এখানে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। ৫৫ বছরের এই পথচলায় চবি জন্ম দিয়েছে অসংখ্য রথী-মহারথীর। যাদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ভৌতবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলাম, সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ সৈয়দ আলী আহসান, চিত্রশিল্পী মূর্তজা বশীর, ঢালী আল মামুন, অধ্যাপক আবুল ফজল, অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সাবেক ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান প্রমুখ।

করোনাকালে করোনা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের গবেষণায় সরব ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। করোনার জিন বিন্যাস, করোনা পরীক্ষা থেকে অনেক কিছুই হয়েছে এখানে।

এত এত প্রাপ্তির মধ্যেও কিছু অপ্রাপ্তির বোঝা এখনও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে। আবাসন সংকট এর মধ্যে অন্যতম। প্রতিষ্ঠার সময় এটি সম্পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় বলা হলেও বর্তমানে ২৭ হাজার ৫৫০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে ১১টি আবাসিক হল ও একটি হোস্টেলে আসন রয়েছে মাত্র ৫ হাজার ৩০টি। যা মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ১৮ শতাংশ। তবে উদ্বোধন হলেও এখনো চালু হয়নি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল। বিশ্ববিদ্যালয়ে দিন দিন শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও শাটল ট্রেনে বাড়েনি কোনো বগি। ১০টিরও বেশি বিভাগে এখনও দুই থেকে আড়াই বছর পর্যন্ত সেশনজট আছে। প্রতিষ্ঠার এত বছরেও এখনো টিএসসি নির্মিত হয়নি। সংরক্ষিত আসন থাকার পরও দেড়যুগ ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে না। নিয়মিত তো দূরের কথা, গড়ে এক যুগে একটি সমাবর্তন হয় না। চাকসু নির্বাচন বন্ধ প্রায় ৩০ বছর ধরে।

৫৫ বছরের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী তানহা ইসলাম ছোঁয়া বলেন, ‘৫৫ বছরে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় যেমন অনেক এগিয়ে গেছে, তেমন কিছু ক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে আছে। ৫৫ বছরে সবচেয়ে বড় যে অপ্রাপ্তি তা হলো নিয়মিত সমাবর্তন না হওয়া। এত বছর পরও আমাদের টিএসসি নেই, যুগ যুগ ধরে চাকসু অকার্যকর। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি যে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি, আমরা তা হলো ছাত্রছাত্রীদের ওপর স্থানীয়দের প্রভাব। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএনজিচালক থেকে শুরু করে বাড়িওয়ালা— সবার কাছে হেনস্তার স্বীকার হচ্ছে শিক্ষার্থীরা।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী অমিত ইবনে হাসান বলেন, ‘যখন বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্ম হয় তখন সবাই পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় হবে এটা আমরা স্বপ্ন বুনতে থাকে। লেখাপড়া, গবেষণা আর মুক্তবুদ্ধির আন্দোলনের নেতৃত্বও দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। কিন্তু আজ সেই ছন্দের পতন অনুভূত হচ্ছে। কেন জানি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নিস্তেজ হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণায় চন্দ্ররেণুবিদ্যার আধিক্য, নোংরা রাজনীতি, চরম দলীয়করণ, অস্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার অভাব আর তোষামোদি শক্তির আবির্ভাবের ফলে আজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের পাত্রে পরিণত হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘দেশের গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করার মূল দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের। প্রাক-প্রাথমিক পর্যায় থেকে প্রশিক্ষণ প্রদান পর্যন্ত সমস্ত শিক্ষা ক্ষেত্র নিয়ে পরিকল্পনা, সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারের কাছে চাপ সৃষ্টিকারী একটি সংস্থা হিসেবে দায়িত্ব পালন করারও কথা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়টির। বিশ্ববিদ্যালয়কে শুধু শিক্ষার্থী আর শিক্ষকদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করার কথা ছিল না বরং দেশের প্রতিটি শিক্ষার্থী আর শিক্ষকের বৈধ অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল।কিন্তু আমাদের আশায় গুঁড়েবালি বলাই যায়।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শিরীণ আখতার বলেন, ১৯৬৬ সালে মাত্র চারটি বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের সংখ্যা ৫৪টি। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে শিক্ষার্থীরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের জন্য কাজ করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। গবেষণায় এখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ব্যাপক সাফল্য অর্জন করছে। বেশকিছু ক্ষেত্রে র‍্যাংকিংয়ে আমরা এগিয়েছি। আগামী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে সবক্ষেত্রে শীর্ষে নিয়ে যেতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

এমআইটি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!