৫০টি একাউন্ট সাম্প্রদায়িক হামলা নিয়ে ভুয়া তথ্য ছড়াচ্ছে, ৭২ ভাগই ভারতীয়
ফ্যাক্ট চেকার প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সাম্প্রদায়িক ভুল তথ্য এবং অপতথ্যের ব্যাপক প্রচারের মাধ্যম হয়ে ওঠেছে সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম এক্স (সাবেক টুইটার)। তথ্য যাচাইকারী বা ফ্যাক্ট চেকার প্রতিষ্ঠান ‘রিউমার স্ক্যানারের’ এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য ওঠে এসেছে।
রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানী দল সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম এক্সে এমন ৫০টি অ্যাকাউন্ট খুঁজে বের করেছে— যেগুলোর কমপক্ষে একটি পোস্টে সাম্প্রদায়িক অপতথ্য ও ভুল তথ্য প্রচারের প্রমাণ মিলেছে। এসব অ্যাকাউন্ট থেকে গত ৫ থেকে ১৩ আগস্টের মধ্যে প্রচারিত পোস্টগুলো দেখা হয়েছে ১ কোটি ৫৪ লাখেরও বেশি বার। ভুয়া তথ্য ছড়ানো এসব অ্যাকাউন্টধারীর ৭২ শতাংশই ভারতে থাকেন। এর মধ্যে দায়িত্বশীল অনেক ব্যক্তিও। এছাড়া এমনকি ভারতের মূলধারার একাধিক গণমাধ্যমেও এসব ভুয়া তথ্য প্রচার করা হয়েছে।
ভুয়া তথ্য প্রচারের ধরনের মধ্যে দেখা গেছে— মুসলিমদের স্থাপনায় সাম্প্রতিক হামলাকে হিন্দুদের স্থাপনায় হামলা দাবি করা হয়েছে, ভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগের ঘটনাকে হিন্দুদের স্থাপনায় হামলার দাবি করা হয়েছে। হিন্দু নিহতের সংখ্যা নিয়েও ভুয়া দাবি তোলা হয়েছে। আবার রাজনৈতিক স্লোগানের বক্তব্যকে ভিন্ন দাবি, স্ক্রিনশট বিকৃতি, ভুয়া বক্তব্য, বিএনপির নামে ভুয়া টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্টের বরাতে ভুল তথ্যসহ কমপক্ষে অর্ধশতাধিক ভুয়া তথ্যের ব্যাপক প্রচার লক্ষ্য করেছে রিউমার স্ক্যানার টিম।
ভুয়া তথ্যের প্রচারে ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই ব্যবহার হয়েছে ভিডিও ফুটেজ। এসব ভিডিও ফুটেজের মধ্যে ১৫টি ছিল গত ৫ আগস্টের আগের অন্য কোনো ঘটনার। বাকিগুলো সরকার পতন পরবর্তী সময়ে ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা হলেও এসব ফুটেজকে সাম্প্রতিককালে ঘটেছে— এমন সাম্প্রদায়িক ভুয়া তথ্যের প্রচারে ব্যবহার করা হয়েছে। অন্যদিকে ১৬ শতাংশ ক্ষেত্রে ছবি ও স্ক্রিনশট এবং বাকি চার শতাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়েছে ছবি ও ভিডিওবিহীন স্ট্যাটাস।
দীপক শর্মা নামের একটি এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে ৯ আগস্ট একটি ভিডিও পোস্ট করে দাবি করা হয়, বাংলাদেশের হিন্দু নারী ও শিশুদের একটি শিবিরে (ক্যাম্প) জিহাদিরা বোমা হামলা চালিয়ে শত শত নারীকে হত্যা করেছে। তবে রিউমার স্ক্যানার যাচাই করে দেখেছে, এটি গত ৭ জুলাই বগুড়ায় জগন্নাথ দেবের রথযাত্রায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পাঁচজনের মৃত্যুর ঘটনার ভিডিও।
এক হিন্দু ব্যক্তি তাঁর নিখোঁজ পুত্রের সন্ধান দাবিতে মানববন্ধন করছেন—এমন দাবি করে একটি ভিডিও ভারতের মূলধারার গণমাধ্যম এশিয়ান নিউজ ইন্টারন্যাশনাল (এএনআই), এনডিটিভি, মিরর নাউ–এর এক্স অ্যাকাউন্টে প্রচার করা হয়। রিউমার স্ক্যানার যাচাই করে দেখেছে, বাবুল হাওলাদার নামের ওই ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে মুসলমান। ২০১৩ সাল থেকে তিনি নিখোঁজ থাকা তার ছেলের সন্ধানের দাবিতে এই মানববন্ধনে অংশ নিচ্ছিলেন।
বাংলাদেশের অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধনকে হিন্দু দাবি করে একটি ভিডিওর মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে, বাংলাদেশে হিন্দু নারীর কান্না করে বক্তৃতা দেয়ার দৃশ্য। বাঁধন নিজেই বিষয়টির প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এমন আরও ১৭টি ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে রিউমার স্ক্যানারের ইনভেস্টিগেশন ইউনিট।
সাম্প্রদায়িক অপতথ্যের প্রচারে ভারতীয় মূলধারার গণমাধ্যম এবং গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদেরও সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে রিউমার স্ক্যানার। এই তালিকায় রয়েছে জি নিউজ মধ্যপ্রদেশ ও নিউজ টুয়েন্টিফোর নামে একটি গণমাধ্যমের এক্স অ্যাকাউন্ট।
ভারতের আরেক পরিচিত গণমাধ্যম অপিইন্ডিয়ার প্রধান সম্পাদক নূপুর শর্মাও তার এক্স অ্যাকাউন্টে নিয়মিত বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রদায়িক অপতথ্য ছড়িয়েছেন বলে উল্লেখ করেছে রিউমার স্ক্যানার। গত ১১ আগস্ট প্রকাশিত নূপুর শর্মার একটি এক্স পোস্টকে ভুয়া তথ্য হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে সেটা জানানোর পরপরই তিনি রিউমার স্ক্যানারের একজন সদস্যকে এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে ‘ব্লক’ করে দেন।
ভুয়া তথ্য ছড়ানো অ্যাকাউন্টধারীর ৭২ শতাংশই ভারতে থাকলেও বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছে অন্য দেশ থেকেও।পাকিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক লেগস্পিনার দানিশ কানেরিয়া নিজের এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেটার লিটন দাসের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে দাবি করা একটি ভিডিও শেয়ার করেন। যদিও সেটি ছিল বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য মাশরাফির বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা। লিটনের বাড়িতে হামলার কোনো ঘটনাই ঘটেনি। এছাড়া ইরাকি বংশোদ্ভূত সালওয়ান মোমিকা নামের এক ব্যক্তি তার এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে নিয়মিত বাংলাদেশকে জড়িয়ে সাম্প্রদায়িক অপতথ্য ছড়িয়েছেন।