৪ লাখ মানুষকে বাঁচাতে পটিয়াকে পানি সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা, নিয়ন্ত্রণ হবে কঠোর নিয়মে

চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলা দীর্ঘদিন ধরে তীব্র পানিসংকটে ভুগছে। ভূ-গর্ভস্থ পানি অতিরিক্ত উত্তোলন এবং অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান ও কৃষি কার্যক্রমের কারণে পানির স্তর প্রতি বছর কমে যাচ্ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, জনস্বাস্থ্য ও কৃষিকাজ দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব অবস্থার প্রেক্ষিতে সরকার মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) পটিয়াকে পানি সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে সরকারি গেজেটে ঘোষণা করেছে।

৪ লাখ মানুষকে বাঁচাতে পটিয়াকে পানি সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা, নিয়ন্ত্রণ হবে কঠোর নিয়মে 1

পটিয়া উপজেলার ৪ লাখের বেশি মানুষ দীর্ঘদিন পানি সংকটে ভুগছেন। শিল্পকারখানার গভীর নলকূপ ব্যবহার এবং টিউবওয়েলের বিকলতার কারণে গ্রামের পানির স্তর প্রতি বছর ৩ থেকে ৭ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে। হাবিলাস দ্বীপ, চরকানাই, হুলাইন, পাচুরিয়া ও হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ৩৫০টি টিউবওয়েলও কার্যকারিতা হারিয়েছে। ফলে কৃষিকাজ ব্যাহত হচ্ছে এবং বোরো আবাদে লবণাক্ত পানি ছড়িয়ে পড়ায় কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ছেন।

পানি সংকট নিরসনের উদ্দেশ্যে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাংলাদেশ পানি আইন, ২০২৩-এর ধারা ১৭ অনুযায়ী জলাধার ও পানি স্তর সংরক্ষণ এবং সুষ্ঠু পানি ব্যবস্থাপনার জন্য অতি উচ্চ, উচ্চ ও মধ্যম পানি সংকটাপন্ন এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। পটিয়া পৌরসভার ৫টি মৌজা অতি উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এবং ৩টি মৌজা উচ্চ পানি সংকটাপন্ন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। উপজেলার ৩টি ইউনিয়নের ৭টি মৌজা অতি উচ্চ, ৯টি ইউনিয়নের ২৭টি মৌজা উচ্চ এবং ৮টি ইউনিয়নের ৩০টি মৌজা মধ্যম সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে মন্ত্রণালয় ১১টি কঠোর নির্দেশনা জারি করেছে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, খাবার পানি ব্যতীত নতুন কোনো নলকূপ স্থাপন এবং বিদ্যমান নলকূপ থেকে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন বন্ধ রাখতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানি নির্ভর শিল্প স্থাপন ও খাল, বিল, পুকুর, নদীসহ কোনো জলাধারের শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। জনগণের ব্যবহারযোগ্য জলাধর ইজারা দেওয়া ও জলস্রোতের স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত করা যাবে না। নদী ও জলাশয়ে বসতবাড়ি বা শিল্প প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য নিষিদ্ধ করা হবে। এছাড়া অধিক পানি নির্ভর ফসল উৎপাদন সীমিত করে পানি সাশ্রয়ী ফসলের আবাদ করতে হবে।

পটিয়া উপজেলার পানি সংকট মোকাবিলায় ২৩ ও ২৪ এপ্রিল পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা (ওয়ারপো)-র মহাপরিচালক লুতফুর রহমান এবং মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আমিনুল হক উপজেলার ১৭টি ইউনিয়ন ও পৌরসভা সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফারহানুর রহমানের সভাপতিত্বে দুই দিনব্যাপী কর্মশালায় পানি সংকট মোকাবিলার করণীয় নির্ধারণ করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পটিয়া এলাকায় দুই বছরের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন বন্ধ রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

পানি সংকট মোকাবিলায় অংশীজনরা তিনটি প্রস্তাব রেখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে, পরিবারভিত্তিক টিউবওয়েল স্থাপন বন্ধ করে কমিউনিটি ভিত্তিক টিউবওয়েল স্থাপন করা, শিল্পকারখানার জন্য হালদা নদীর মিঠা পানি সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া এবং বোয়ালখালীর ভান্ডালজুড়ি থেকে চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি সংযোগ নেওয়ার উদ্যোগ।

এর আগে হাইকোর্টের নির্দেশনায় চারটি গ্রামকে অতি উচ্চ পানি সংকটাপন্ন ঘোষণা করা হয়েছিল। আদালত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন থেকে বিরত থাকতে এবং দূষণ থেকে জনস্বাস্থ্য রক্ষা করতে নির্দেশ দিয়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং জেলা প্রশাসককে আটটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের দূষণের পরিমাণ যাচাই করে ক্ষতিপূরণ আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সরকারের এই পদক্ষেপের মাধ্যমে পটিয়া উপজেলার পানি ব্যবস্থাপনা ও জলাধার সংরক্ষণের জন্য প্রথমবারের মতো আইনি ভিত্তি তৈরি হলো। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা লঙ্ঘন দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। পটিয়ার পানি সংকট নিরসনে সরকারের উদ্যোগ এবং আদালতের নির্দেশ কার্যকর হওয়ায় আশা করা যাচ্ছে, আগামী দুই বছরে এলাকাটির ভূগর্ভস্থ পানি স্তর পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে।

ksrm