৪০ স্প্লিন্টার হাছান মাহমুদের শরীরে, তথ্যমন্ত্রীর মুখে ভয়াবহ দিনটির কথা

সেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার বিভীষিকা এখনও তাকে তাড়া করে বেড়ায়। এখনও শরীরে তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন ৪০টি গ্রেনেডের স্প্লিন্টার। গ্রেনেডের ক্ষত ও সেদিনের দুঃসহ দিনগুলো এখনও তিনি ভুলতে পারেননি। দুই শতাধিক স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে আহত অবস্থায় ফিরে আসেন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থেকে নির্বাচিত সাংসদ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।

তিনি ছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সহকারী। তিনি ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার একজন অন্যতম রাজসাক্ষীও।

জানা যায়, ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলার মুহূর্তে তিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য অস্থায়ীভাবে ট্রাকের ওপর তৈরিকৃত মঞ্চের পাশেই ছিলেন। ঘাতকদের গ্রেনেড হামলা শুরু হওয়ার সাথে সাথে তিনিসহ শেখ হাসিনার পাশে থাকা সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতারা মানবদেয়াল রচনা করে শেখ হাসিনাকে রক্ষার চেষ্টা করেন। এ সময় তার শরীরে গ্রেনেডের প্রায় ২০০ স্প্লিন্টার বিঁধে যায়।

৪০ স্প্লিন্টার হাছান মাহমুদের শরীরে, তথ্যমন্ত্রীর মুখে ভয়াবহ দিনটির কথা 1

এদিকে গ্রেনেড হামলার ঘটনায় ড. হাছান মাহমুদের একটি রক্তাক্ত ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। ছবিতে দেখা যায় গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত ড. হাছান মাহমুদ রক্তে রঞ্জিত। তার সারা শরীরে রক্ত ঝরছে। রক্তে লাল হয়ে গেছে পরনের শার্ট। কাঁদছেন হাছান মাহমুদ। খুলে গেছে শার্টের বোতাম। দলের নারীনেত্রী অ্যাডভোকেট রুবিনা মিরা ও অপর এক নেত্রীর কাঁধে ভর দিয়ে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। গুরুতর আহত অবস্থায় ড. হাছান মাহমুদকে দুই নারী নেত্রী প্রথমে ঢাকার সিকদার মেডিকেলে ভর্তি করান। সেখানে ৮ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ২৯ শে আগস্ট তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বেলজিয়ামে নিয়ে যাওয়া হয়। বেলজিয়ামে কয়েকটি স্প্লিন্টার বের করতে পারলেও এখনও ৪০টি স্প্লিন্টার শরীরে রয়ে গেছে।

ভয়াবহ ২১শে আগস্টের সেদিনের ঘটনা বর্ণনা দিয়ে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘বিস্ফোরিত গ্রেনেডে গুরুতর আহত হলে আমাদের দলের দুই নারী নেত্রীর সহায়তায় কোনোভাবে একটি বাসে উঠেছিলাম। যখন আমি হাসপাতালের পথে তখন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মনে হচ্ছিল আমার সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। যদি আর এক ঘণ্টা দেরি হতো, তাহলে সেদিন অন্য কিছু হয়ে যেতে পারতো। ওইদিন বিস্ফোরিত আর্জেস গ্রেনেডের অসংখ্য স্প্লিন্টার শরীরে ঢুকে যায়। চিকিৎসকরা কিছু স্প্লিন্টার বের করলেও ৪০টির মতো স্প্লিন্টার এখনও শরীরে রয়ে গেছে। যেগুলো বের করতে গেলে নার্ভ কেটে বের করতে হবে। ফলে আমার মৃত্যুও হতে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বাকি স্প্লিন্টার গুলো বের করিনি।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখনও আমার শরীরের নিচের অংশে ৪০টি স্প্লিন্টার আছে। তবে এতগুলো স্প্লিন্টার শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছি তারপরও ভাল লাগচ্ছে যে, সেদিন নেত্রীর পাশে দাঁড়াতে পেরেছিলাম। ঘাতকদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিতে পেরেছিলাম। সেদিন আমাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য আমাদের দলের দুই নারীনেত্রীর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই।’

তথ্যমন্ত্রী জানান, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও পরবর্তীতে চার জাতীয় নেতা এবং সর্বশেষ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা একইসূত্রে গাঁথা। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্য এ হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল। শুধু হত্যার চেষ্টাই করেনি, ঘটনার পর জজ মিয়া নাটকের মাধ্যমে বিচার কার্যক্রমকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করেছে। ন্যাক্কারজনক ওই ঘটনার জন্য জাতি তাদের ক্ষমা করেনি।’

তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী কোনোদিন অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে না। বিপদের দিনে ভয়ে পিছিয়ে যায় না। সেটারই প্রমাণ আমার শরীরে বিঁধে থাকা চল্লিশটি স্প্লিন্টার। আমরা শোককে শক্তিতে পরিণত করে রাজনীতি করে গেছি। যারা রাজনীতির বদলে ষড়যন্ত্র করেছেন, যারা হত্যার রাজনীতি করেছে তারা কেউ আমাদের থামাতে পারেনি। বরং নিজেরা থেমে গেছেন।’

১৯৬৩ সালের ৫ জুন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নে সুখবিলাস গ্রামে জন্ম নেন ড. হাছান মাহমুদ। তিনি অনেক বাধা-বিপত্তি মোকাবেলা করে আজকের অবস্থানে উঠে এসেছেন।

ড. হাছান মাহমুদ ১৯৭৭ সালে প্রথম চট্টগ্রাম মহানগরের জামালখান ওয়ার্ড ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। ১৯৭৮ সালে চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে চট্টগ্রাম মহসিন কলেজে ভর্তি হয়ে ওতপ্রোতভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭৯ সালে চট্টগ্রাম হাজী মহসিন কলেজের ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।এরপর চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের শিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৭ সালে তিনি সামরিক শাসক এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় গ্রেফতার হন। ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সামনের কাতারে থেকে চট্টগ্রামের ছাত্রসমাজকে নেতৃত্ব দেন ড. হাছান মাহমুদ। এরপর ১৯৯০ সালে চাকসু নির্বাচনের জন্য গঠিত সর্বদলীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক মনোনীত হন। রসায়নে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন কিছুদিন। ১৯৯২ সালে সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে যুক্ত হন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগে। ১৯৯২ সালে, তিনি উচ্চতর শিক্ষার জন্য বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে যান। ভর্তি হন বিশ্বের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ ব্রিজ ইউনিভার্সিটি ব্রাসেলসে। এসময় তিনি বেলজিয়াম আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। ১৯৯৩ সালে ব্রাসেলস এর বাংলাদেশ ছাত্র সংসদের সভাপতি নির্বাচিত হন। পরে ১৯৯৩ সালে বেলজিয়াম আওয়ামী লীগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ১৯৯৫ সাল থেকে মার্চ ২০০০ পর্যন্ত বেলজিয়াম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

মূলত ব্রিজ ইউনিভার্সিটির দক্ষিণ এশিয়াভিত্তিক স্টুডেন্ট ফোরামের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনায় আসেন ড. হাছান মাহমুদ।

এসময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দসহ আন্তর্জাতিক রাজনীতিকদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ১৯৯৪ সালে তিনি ‘ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন অব দ্য ইউনিভার্সিটি’র সভাপতি নির্বাচিত হন, যা ৬০ টি দেশের ১৫০০ শিক্ষার্থীর প্রতিনিধিত্ব করে।

এরপর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার ডাকে সাড়া দিয়ে বিদেশে শিক্ষকতা ও নিরাপদ জীবনের চাকরি ফেলে দেশে ফিরে আসেন। এসেই ২০০১ সালের অক্টোবরে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী হিসেবে নিযুক্ত হন। এবং জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির (২০০১ সাল) সঙ্গে যুক্ত হন। কিছুদিনের মাথায় আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তিনি বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পান। তখন থেকেই তিনি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য।

২০০৭ সালে যখন, আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা সামরিক সমর্থিত সরকার কর্তৃক গ্রেফতার হলে, তখন ড. হাছান মাহমুদ দলীয় সভাপতির মুখপাত্র হিসেবে অকুতোভয়ে কাজ করেন, যা দলের নেতা- কর্মীদের কাছে অত্যন্ত প্রশংসিত হয়। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া) আসন থেকে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করেন তিনি। প্রথম বারেই তিনি বিএনপির প্রার্থী তথা দেশের নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন । নির্বচিত হয়েই ২০০৯-২০১৩ সময়কালে তিনি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও পরিবেশ ও বন প্রতিমন্ত্রী এবং পরবর্তীতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালেও তিনি টানা তৃতীয় বার রাঙ্গুনিয়া থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

সর্বশেষ ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির আ. লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন, এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের রাজনৈতিক জীবনে তিনি বারবার মৌলবাদী অপশক্তি ও স্বাধীনতাবিরোধীদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার ও কয়েকবার প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু কোন রক্তচক্ষু তাকে সংগ্রামের পথ থেকে পিছু হটাতে পারেনি। বিভীষিকার দীর্ঘ ১৬ বছর পার হয়ে গেলেও একটি মুহূর্তের জন্যও সেই নারকীয় দিনটি স্মরণ থেকে বিস্তৃত হয়নি বলে জানান তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!