৪০ বছর পর জন্মদাত্রী মাকে স্বীকার করলেন নওফেল, এনআইডি-হলফনামায় আছে সৎ মায়ের নাম

প্রায় ৪০ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল তার জন্মদাত্রী মাকে স্বীকার করে নিলেন। জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট ও নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামাতেও প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম মহিউদ্দিনের এই জ্যেষ্ঠ পুত্র মায়ের নামের পাশে তার সৎ মা হাসিনা মহিউদ্দিনের নাম লিখেছেন।

বিয়ের আসরে এবিএম মহিউদ্দিন ও শাহিদা মহিউদ্দিন।
বিয়ের আসরে এবিএম মহিউদ্দিন ও শাহিদা মহিউদ্দিন।

গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল পালিয়ে প্রথমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যান। এরপর তিনি লন্ডনে যান বলে জানা গেছে। তার স্ত্রী এমা ক্লেয়ার বার্টন ব্রিটিশ নাগরিক। নওফেলের নিজেরও ব্রিটিশ নাগরিকত্ব রয়েছে।

শুক্রবার (২৭ জুন) অজ্ঞাত এক স্থান থেকে দেওয়া এক ভিডিওবার্তায় নওফেল সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন, ‘শৈশব থেকে আওয়ামী লীগকে দেখে এসেছি। আমার নিজের মা বোমা বিস্ফোরণে মারা গিয়েছিলেন। আমার বাবা বছরের পর বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। আমার বোন, এই দলের জন্য আমাদের যে পরিস্থিতি, বিনা চিকিৎসায় ক্যান্সারে মারা যায়।’

নওফেলের এই স্বীকারোক্তিকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। অনেকে এই স্বীকারোক্তিকে স্বাগত জানাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার নিজের জন্মদাত্রী মাকে এতো বছর ধরে অস্বীকার করার জন্য নওফেলকে দুষছেন।

মায়ের নাম গোপন, ঠিকানায় গরমিল—আগেও ওঠেছিল বিতর্কের ঝড়

এর আগে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মায়ের নাম গোপনসহ হলফনামা ও মনোনয়নপত্রে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগ ওঠে নওফেলের বিরুদ্ধে। এই অভিযোগে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী-বাকলিয়া) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের প্রার্থিতা বাতিল ও মনোনয়ন অবৈধ ঘোষণা করতে লিখিত আবেদন জানান একই আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সানজীদ রশীদ চৌধুরী।

শনিবার (৯ ডিসেম্বর) নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ে পাঠানো তিন পৃষ্ঠার অভিযোগে জানানো হয়, মহিবুল হাসান চৌধুরীর হলফনামা ও মনোনয়নপত্রে মাতার নাম ‘হাসিনা মহিউদ্দিন’ উল্লেখ করা হলেও বাস্তবে তার জন্মদাত্রী মাতা হলেন মরহুমা শাহেদা আক্তার ওরফে শাহেদা মহিউদ্দিন। এছাড়া তার বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানার মধ্যে গরমিল পাওয়া গেছে।

নির্বাচন কমিশন বরাবরে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়, মহিবুল হাসান চৌধুরীর পিতা প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ও চট্টগ্রাম সিটির সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ১৯৮২ সালের মার্চে সেন্ট প্লাসিডস স্কুলের শিক্ষিকা শাহেদা আক্তারকে বিয়ে করেন। পরে সামাজিকভাবে তিনি ‘শাহেদা মহিউদ্দিন’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। শাহেদা আক্তারের গর্ভে ১৯৮৩ সালের ২৬ জুলাই মহিবুল হাসান চৌধুরীর জন্ম হয়। ১৯৮৬ সালের ১৯ অক্টোবর এক মর্মান্তিক বোমা দুর্ঘটনায় নিজ বাড়িতে শাহেদা মহিউদ্দিন মৃত্যুবরণ করেন। এ বিষয়ে পাঁচলাইশ থানায় মামলাও হয়। সেই দুর্ঘটনায় বানু নামের এক গৃহকর্মীও মৃত্যুবরণ করেন।

অন্যদিকে ১৯৮৭ সালের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে হাসিনা মহিউদ্দিন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তখন মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের বয়স প্রায় ৪ বছর।

হলফনামায় ‘মিথ্যা তথ্য’ দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে অভিযোগে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের সংবিধান, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন-২০১০, বাংলাদেশ উত্তরাধিকার আইনসহ প্রতিটি স্থানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে, ‘মা’-‘মাতা’ অর্থ গর্ভধারিনী। এতে দুধ মা/পালক মা/পিতার দ্বিতীয় স্ত্রীর কোনো স্থান নেই। আপিল আবেদনের সাথে সংযুক্ত সকল দলিলাদির দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, মহিবুল হাসান চৌধুরীর জন্মদাত্রী মাতা মরহুমা শাহেদা মহিউদ্দিন এবং হাসিনা মহিউদ্দিন তার পিতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর দ্বিতীয় স্ত্রী, গর্ভধারিনী নন।’

একই অভিযোগে মহিবুল হাসান চৌধুরীর এনআইডি, হলফনামা এবং জাতীয় সংসদের সাংসদ ডায়েরিতে বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানার গরমিল আছে বলে উল্লেখ করা হয়।

নির্বাচন কমিশনে জমা পড়া মনোনয়নপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী-বাকলিয়া) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের ঠিকানা এবার বদলে গেছে। একাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় নওফেলের ঠিকানা লেখা ছিল তাদের পৈতৃক বাড়ি — ২০৭ চশমা হিল আবাসিক এলাকা, ডাকঘর: পলিটিক্যাল ইন্সটিটিউট ৪২০৯, খুলশী। আর এবার জমা দেওয়া হলফনামায় নওফেলের পুরনো পৈত্রিক ঠিকানা বদলে নতুন ঠিকানা লেখা হয়েছে— গ্রাম: হাজারী লেইন, কে সি দে রোড, কোতোয়ালী, চট্টগ্রাম।

এদিকে অভিযোগকারী জাতীয় পার্টির প্রার্থী সানজীদ রশীদ চৌধুরী বিষয়গুলো যাচাই করে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ (২০২৩ পর্যন্ত সংশোধিত) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন পর্যালোচনা করে মিথ্যা ও অসত্য তথ্য দেওয়ার কারণে মহিবুল হাসান চৌধুরীর প্রার্থিতা বাতিল ও মনোনয়ন অবৈধ ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন। তবে নির্বাচন কমিশন এসব অভিযোগ গ্রহণ করতে অস্বীকার করে।

থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন ছিলেন টুম্পা

অন্যদিকে সম্প্রতি দেওয়া বক্তব্যে নওফেল তার বোন ফৌজিয়া সুলতানা টুম্পা বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন— এমন দাবি করলেও জানা গেছে, টুম্পা থাইল্যান্ডের ব্যাংককে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। টুম্পা ২০০৮ সালের ১৭ অক্টোবর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

চট্টগ্রামের রাজনীতিক ও সংগঠক সাজ্জাত হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘২০০৭ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সিটি মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তিনি জেলে থাকা অবস্থাতেই তাঁর মেয়ে ফৌজিয়া সুলতানা টুম্পার ক্যান্সার ধরা পড়ে। ব্যাংককে চিকিৎসাধীন মেয়েকে দেখতে তার পরিবার প্যারোলে মুক্তি চাইলে মহিউদ্দিনকে ‘রাজনীতি ছাড়া’র শর্ত দেওয়া হয়। সেই শর্ত মানেননি তিনি। ২০০৮ সালের ৮ অক্টোবর মহিউদ্দিন জামিনে মুক্ত হলেও ব্যাংককে যেতে সরকার তালবাহানা করে যাত্রা বিলম্বিত করেছিল। শেষ পর্যন্ত ব্যাংককে পৌঁছার আগেই ১৭ অক্টোবর চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বসে তিনি টুম্পার মৃত্যু সংবাদ পান। টুম্পার মৃত্যুর সময় পাশে থাকতে না পারার এই দুঃখের কথা আমৃত্যু বলতেন মহিউদ্দিন চৌধুরী।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm