৩ কোটির মারাত্মক রাসায়নিক নষ্টে খরচ ৭০ কোটি, চট্টগ্রাম থেকে ফ্রান্সে গেল বিপজ্জনক ডিডিটি
৫০০ মেট্রিক টন ডিডিটি ৩৮ বছর ধরে পড়ে ছিল চট্টগ্রামে
অবশেষে ডিডিটি (ডাইক্লোরো ডাইফেনাইল ট্রাইক্লোরো ইথেন) মুক্ত হলো চট্টগ্রাম। প্রায় ৩৮ বছর পর এই বিপজ্জনক রাসায়নিক ধ্বংস করার জন্য পাঠানো হয়েছে ফ্রান্সে। ৩ কোটিতে কেনা ৫০০ মেট্রিক টন ডিডিটি ধ্বংস করার পেছনে খরচ পড়ছে ৭০ কোটি টাকা। এই ডিডিটি মূলত ম্যালেরিয়াসহ ক্ষতিকর মশা ও কীটপতঙ্গ মারার জন্য ব্যবহৃত হতো। পরে এর বিষক্রিয়া সম্পর্কে জানার পর নিষিদ্ধ করা হয় বিশ্বব্যাপী।
পৃথিবীতে ডিডিটির সর্ববৃহৎ মজুদটি ছিল চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদ এলাকার ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ হেলথ সার্ভিসেসের (ডিজিএইচএস) মেডিকেল সাব-ডিপোতে। পরিত্যক্ত অবস্থায় ৫০০ মেট্রিক টন বিষাক্ত ডিডিটি পড়েছিল গুদামে। যার ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতো না খোদ গুদাম কর্তৃপক্ষই।
২০২১ সালে ডিডিটির উপস্থিতি জানার পর তা ধ্বংস করার উদ্যোগ নেয় সরকার এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। এজন্য তা পাঠানো হয় ফ্রান্সে। একমাত্র ফ্রান্সেই ডিডিটি ধ্বংসের আধুনিক কলা-কৌশল রয়েছে।
তবে এই বিপজ্জনক রাসায়নিক ফ্রান্সে পাঠানোর বিষয়টি খুব সহজ ছিল না। মানুষের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হওয়ায় বিশেষ পোশাকে শুধুমাত্র পরীক্ষিত লোক দিয়েই তা বিষেশায়িত জাহাজে পাঠানো হয় ফ্রান্স। ডিডিটির অপসারণ অপারেশনের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণায় এক সমাপনী অনুষ্ঠান আয়োজন করে সরকার এবং এফএও।
বুধবার (৩০ নভেম্বর) ডিডিটি অপসারণ প্রক্রিয়াকে স্মরণীয় করে রাখতে নগরীর পাঁচ তারকা হোটেলে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে ডিডিটি অপসারণে কাজ করা শ্রমিকদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়।
পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদের সভাপতিত্বে এতে প্রধান অতিথি ছিলেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তফা কামাল।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. আশরাফ উদ্দিন। আরও উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশ শাখা) সঞ্জয় কুমার ভৌমিক এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ড. আবদুল হামিদ।
বিদেশের রাসায়নিক বিশেষজ্ঞ ফুড অ্যান্ড এগ্রিকার্লচারাল অর্গানাইজেশনের (ফাও) বাংলাদেশ ডিভিশনের সিনিয়র টেকনিক্যাল এডভাইজার সাসো মার্টিনো এবং মার্ক ডেভিসও উপস্থিত ছিলেন।
কী এই ডিডিটি
সুইডিশ রসায়নবিদ পল হারমান মুলার ১৮৭৪ সালে আবিষ্কার করেন এই রাসায়নিক। তবে কীটনাশক হিসেবে এর ব্যবহার শুরু হয় ১৯৩৯ সাল থেকে। ১৯৫০ এবং ১৯৮০ এর দশকের মধ্যে ডিডিটি ব্যাপকভাবে কৃষিশিল্পে কীটনাশক হিসাবে ব্যবহার হয়। এই রাসায়নিক আবিষ্কারের জন্য মুলার নোবেল পুরস্কারও পান।
ছিল স্বাস্থ্যঝুঁকিও
ডিডিটি এমন একটি রাসায়নিক জৈব যা বহু বছর পর্যন্ত তার বিষক্রিয়া নষ্ট না করে যে কোনো পরিবেশে টিকে থাকতে পারে। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া যায় যে, এই যৌগটি মাটিতে প্রবেশ করলে তা ৩০ বছর পর্যন্ত সেখানে অবিকৃত অবস্থায় থাকতে পারে। ডিডিটি মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে তা সরাসরি এন্ড্রোক্রাইন (অন্তঃক্ষরানগ্রন্থি) সিস্টেমে আক্রমণ করে। যে মানুষের শরীরে ডিডিটির উপস্থিতি থাকবে সে মানুষের হরমোন নিঃসরণে বাধা তৈরি করবে।
এছাড়াও ডিডিটি রাসায়নিকের উপাদানগুলো মানব শরীরে ক্যান্সারের মত জীবনঘাতী রোগ সৃষ্টিতে সহায়তা করে। ডিডিটি গর্ভবতী মহিলাদের নিয়মিত থাইরয়েড ফাংশনে ব্যাঘাত ঘটায়। এই যৌগ শিশুদের বিকলাঙ্গতা তৈরির জন্য দায়ী বলেও জানান বিশেষজ্ঞরা।
যেভাবে চট্টগ্রামে এলো ডিডিটি
১৯৮৪ সালে পাকিস্তান থেকে ৫০০ মেট্রিক টন ডিডিটি আমদানি করা হয়। সেই আমদানি পণ্য আগ্রবাদের কেন্দ্রীয় ওষুধাগারের (ডিজিএইচএস) গুদামে রাখা হয়। পরে বিশ্বব্যাপী এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করলে তা এতবছর থেকে যায়। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে এলাকার মাটি এবং পানির সঙ্গে মিশে যায় এই রাসায়নিক।
জাতিসংঘের কীটনাশক বিশেষজ্ঞ মার্ক ডেভিস ডিডিটির এই মজুদকে ‘অত্যন্ত অস্বাভাবিক’ হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমার জানামতে, একটি সুনির্দিষ্ট এলাকা থেকে এত পরিমাণের ডিডিটি কীটনাশক অপসারণের ঘটনা আর নেই। এটি অত্যন্ত অস্বাভাবিক যে, এটি একটি শহরের প্রাণকেন্দ্রে সংরক্ষণ করা হয়েছিল।’
যেহেতু যৌগটি ভেঙে যায় না, তাই চালানটির সক্রিয় উপাদানগুলো আজও ঠিক একই ঘনত্বে রয়েছে। ডিডিটি মানুষ ও অন্যান্য জীবের জন্য বিষাক্ত এবং বিপজ্জনক। ডিডিটি স্থায়ী জৈব দূষণকারী (পিওপি) হিসেবে প্রাণীদেহের পাশাপাশি বৃহত্তর পরিবেশেও জমা হয়।
যেভাবে সরানো হলো সর্ববৃহৎ ডিডিটির মজুদ
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার অভিজ্ঞ কর্মী এবং বাংলাদেশ সরকারের তত্ত্বাবধানে গ্রিসভিত্তিক একটি বিশেষজ্ঞ কোম্পানি ক্ষতিকর ডিডিটি পুনরায় প্যাকিং করতে চার মাস সময় নেয়। যেখানে বাংলাদেশের বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১৭ জন শ্রমিক ৭-৮ মাস ধরে এই ডিডিটি প্যাকেজিং থেকে শুরু করে ২৪ কন্টেইনারে করে জাহাজে তোলা পর্যন্ত কাজ করেছেন।
এই ক্ষতিকর ডিডিটি বাংলাদেশ থেকে ফ্রান্সে নিয়ে যেতেও নানান বাধায় পড়তে হয় জাতিসংঘের এই টিমকে। ডিডিটি অপসারণ সম্পূর্ণভাবে একটি প্রযুক্তিগত প্রক্রিয়া। এটি আন্তর্জাতিক আইন, নিয়ম ও প্রবিধানের আওতায় পড়ে। শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, মিশর, মাল্টা, ইতালি, স্পেন, পর্তুগাল, মরক্কো, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, জার্মানি এবং ফ্রান্স—১৪ দেশ বর্জ্য বহনকারী জাহাজটিকে তাদের আঞ্চলিক জলসীমা দিয়ে ট্রানজিট করার অনুমতি দিয়েছিল। অল্প কিছু দেশই ডিডিটি নিষ্পত্তি করার ক্ষমতা রাখে—ফ্রান্স তাদের একটি।
৩ কোটির ডিডিটি ধ্বংসে খরচ ৭০ কোটি
ডিডিটি অপসারণসহ সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের মোট বাজেট ধরা হয়েছে ৭০ কোটি টাকা। জাতিসংঘের সংস্থা গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি (জিইএফ) পুরো অর্থায়ন করছে। প্রকল্প পরিচালক ফরিদ আহমদ বলেন, ‘পুরো প্রকল্পের বাজেট ৭০ কোটি টাকা। প্রকল্পের মধ্যে দেশের পরিবেশ অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ল্যাবের গবেষণা ও ঝুঁকি হ্রাসকরণ সংক্রান্ত সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয় আছে। সুতরাং সেখানে একটা অংশ খরচ হবে।’
তিনি বলেন, ‘ডিডিটি অপসারণের জন্য প্রয়োজনীয় সভা-কর্মশালা, প্রশিক্ষণ, ১৩ জন কনসালট্যান্টের বেতন-ভাতা সংক্রান্ত আনুষাঙ্গিক কাজেও কিছু ব্যয় হবে। এরপর ৩০ শতাংশের মতো অর্থ খরচ হবে ডিডিটি অপসারণ করে ফ্রান্সে নিয়ে ধ্বংস করার মূল কাজে। ফ্রান্স ছাড়া এই বিপজ্জনক রাসায়নিক ধ্বংস আর তেমন কোনো দেশ করে না। বাজেট এবং টেন্ডার এফএও করেছে। এখানে আমাদের কাজ শুধু তাদের দাপ্তরিক সহযোগিতা দেওয়া।’
যা বলছেন জাতিসংঘের রাসায়নিক বিশেষজ্ঞরা
সাসো মার্টিনভ, যিনি এফএও বাংলাদেশের ডিডিটি অপসারণকারী প্রকল্পের নেতৃত্বে আছেন। তিনি বলেন, ‘এটি ছিল একটি জটিল এবং প্রযুক্তিনির্ভর প্রক্রিয়া। যা যথেষ্ট দক্ষতা এবং পরিকল্পনার সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়। এ প্রক্রিয়া প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে সম্পন্ন করা হয়। আমরা বাংলাদেশ সরকার এবং অংশীদারদের সম্মিলিত সহয়তা পেয়েছি। একইসঙ্গে ডিডিটি স্থানান্তরকারী শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে অনেক প্রতিকূল অবস্থা অতিক্রম করেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটি একটি বড় অর্জন, কিন্তু বাংলাদেশে অন্যান্য কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে এখনও অনেক দূর যেতে হবে। আমরা কীটনাশক ব্যবহারের প্রশাসনিক দক্ষতা ও প্রয়োগকে শক্তিশালী করতে চাই।’
ডিজে