৩১ বছরের কর্মজীবন শেষে চট্টগ্রামের ডা. আবুল কাশেম এবার নতুন লক্ষ্যে
চট্টগ্রাম প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতা
৩১ বছরের চিকিৎসাজীবনে ক্লান্তি কখনও ভর করেনি তার ওপর। চিকিৎসাসেবা ও রুজি রোজগারে চষে বেড়িয়েছেন বৃহত্তর চট্টগ্রামের এদিক-ওদিক। পেয়েছেন মানুষের ভালোবাসা। নিজের অর্জিত জ্ঞান বিলিয়ে দিয়েছেন শিক্ষার্থীদের মাঝে। তাই বোধকরি ৩১ বছরের চিকিৎসা জীবনে অপ্রাপ্তি বলে কিছু নেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডার্মাটোলজি বিভাগের সদ্য সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আবুল কাশেম চৌধুরীর।
বৃহস্পতিবার (৯ ডিসেম্বর) সুদীর্ঘ কর্মজীবন সফলভাবে শেষ করলেন চট্টগ্রামে চর্ম ও যৌনব্যাধির এই কিংবদন্তী চিকিৎসক। নিয়ম অনুযায়ী আগামী এক বছর অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) থাকবেন তিনি।
বিদায়লগ্নে ডা. আবুল কাশেম চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে নিজের অনুভূতি জানাতে গিয়ে বলেন, ‘চিকিৎসাবিদ্যায় লোভনীয় বেশ কয়েকটি বিষয় ছিল যেগুলোতে পোস্ট গ্রাজুয়েট না করে ডার্মাটোলজিতে করেছিলাম। কারণ আমি মনে করেছি চর্মরোগের রোগীরা অনেক অবহেলিত। তারা উপযুক্ত চিকিৎসাসেবা পায় না। বিভিন্ন অপচিকিৎসার শিকার হন। তাই স্কিনে আমি পোস্ট গ্রাজুয়েট করে উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করেছি রোগীদের।’
তিনি বলেন, ‘ছাত্রদের পড়িয়েছি। চিকিৎসা শেষে রোগীরা সুস্থ হয়ে যখন রোগমুক্তির সংবাদটি আমাকে জানায়, তখন ভালো লাগে। আরও তৃপ্তি পাই, যখন রোগীরা বলেন, আপনার কাছে আগে আসলে আরো আগে রোগটি নিরাময় হত। এটাই বোধহয় একজন চিকিৎসকের সবচেয়ে বড় পাওয়া। আর আমি সেটাই পেয়েছি।’
ডা. আবুল কাশেম চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডার্মাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান থেকে আজ (৯ ডিসেম্বর) অবসর নিতে পারলাম সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে— এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছুই হতে পারে না।’
মুঠোফোনের ওপাশ থেকে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে যখন কথাগুলো বলছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডারমাটোলজি বিভাগের সদ্য বিদায়ী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. আবুল কাশেম চৌধুরী, তখন তার হাসিতে তৃপ্তির সুর টের পাওয়া গেলেও গলার স্বরটা ছিল ভারী। কারণ ৩১ বছরের পথচলা শেষে বৃহস্পতিবার (৯ ডিসেম্বর) অধ্যাপনা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেন তিনি।
চর্মরোগের এই কিংবদন্তী চিকিৎসক ২০০১ সাল থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের বিভিন্ন শিক্ষা ও গবেষণা কাজে এবং ডার্মাটোলজি বিভাগে উন্নত চিকিৎসা সেবা প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
এমন এক নামি চিকিৎসককের অবসর গ্রহণের মুহূর্তে বৃহস্পতিবার (৯ ডিসেম্বর) সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শাহ আলম বীর উত্তম মিলনায়তনে তাকে দেওয়া হল ‘বিদায় সংবর্ধনা’।
এতে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক সাহেনা আক্তার। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ইউরোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ মনোয়ার উল হক, মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ আবুল হাসান চৌধুরী, নিউরোসার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এসএম নোমান খালেদ চৌধুরী, মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক এমএ সাত্তার প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডার্মাটোলজি বিভাগের অগ্রযাত্রায় বিদায়ী অধ্যাপক আবুল কাশেম চৌধুরীর অসামান্য অবদান রয়েছে। তার এ অবদানের কথা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সকল শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা সবসময় স্মরণ রাখবে।
শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. কামরুন নাহারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের বিভিন্ন বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, শিক্ষক, পোস্ট গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে বিদায়ী অধ্যাপককে ক্রেস্ট উপহার দিয়ে সম্মান জানানো হয়।
আবুল কাশেম চৌধুরীর জন্ম চট্টগ্রাম শহরের পাথরঘাটায় আশরাফ আলী রোডে ১৯৬২ সালের ১০ ডিসেম্বর। বাবা আব্দুল মোনাফ চৌধুরী। ৪ ভাই ৩ বোনের মধ্যে তিনিই বড়। ১৯৭৮ সালে সরকারি মুসলিম হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন তিনি। কুমিল্লা রোর্ডে সে সময় তিনি মেধাতালিকায় বিজ্ঞান বিভাগে ১৩ তম ও যুগ্ম তালিকায় ১৭তম স্থান দখল করেন। এরপর ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে। ১৯৮০ সালে এইচএসসি পাস করেন যুগ্ম মেধাতালিকায় ১২তম স্থান দখল করে।
আবুল কাশেম চৌধুরী ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ১৯৮৭ সালের জানুয়ারিতে তিনি এমবিবিএস পাস করেন। এরপর অষ্টম বিসিএসে উর্ত্তীর্ণ হয়ে ১৯৮৯ সালের ২০ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা হেলথ কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। এরপর ১৯৯০ সালের শেষের দিকে কক্সবাজারের উখিয়া হেলথ কমপ্লেক্সে বদলি হন।
১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে বদলি হন। এরপর ১ বছর ১০ দিন তিনি ডিডিভি (ডিপ্লোমা ইন ডার্মাটোলজি এন্ড ভেনেরিওলজি) সম্পন্ন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন পিজি হাসপাতাল থেকে। ২০০৪ সালে শেষ করেন এফসিপিএস। এ সময় চট্টগ্রাম মেডিকেল থেকে তিনি আমেরিকান হাসপাতালে বদলি হন। এরপর আবারও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চর্ম বিভাগের মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগদান করেন।
এর মধ্যে কেটে যায় ৬ বছর। এরপর জুনিয়র কনসালট্যান্ট হিসেবে পটিয়া হেলথ কমপ্লেক্সে নিয়োগ পান। এখানে ২০১০ সালের ১০ মার্চ থেকে ২০১১ সালের ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন শেষে সহকারী অধ্যাপক হয়ে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে যোগদান করেন ২০১১ সালের ৭ ডিসেম্বর। সেখানে তিনি দায়িত্ব পালন করেন ২০১৭ সালের ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত। এ সময় তিনি সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। এরপর একই বছরের ৩০ এপ্রিল তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে বদলি হয়ে আসেন ডার্মাটোলজি বিভাগে। ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে ডার্মাটোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পান ডা. আবুল কাশেম চৌধুরী।
ডা. আবুল কাশেম চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই করোনা চলে আসে। চর্মবিভাগটি করোনা চিকিৎসায় রেডজোন ওয়ার্ড করা হয়। করোনাকালে পুরো বিভাগটি হাসপাতাল ও কলেজ কর্তৃপক্ষকে নানাভাবে সহায়তা দিয়েছে।’
বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডার্মাটোলজি বিভাগটি বৃহত্তর চট্টগ্রামের উন্নত চিকিৎসাসেবার একটা আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকাল আটটা থেকে হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগীর লম্বা লাইন পড়ে যায়। জানা গেছে, বর্তমানে এ ওয়ার্ডের বহির্বিভাগে প্রতিদিন ৫৫০ থেকে ৬০০ জন রোগী সেবা নিয়ে থাকে। বৃহস্পতিবার (৯ ডিসেম্বর) পর্যন্ত এ বিভাগের অন্তঃবিভাগে রোগী ভর্তি আছে ২৫ থেকে ৩০ জন। প্রতিদিন এ বিভাগে পোস্টগ্রাজুয়েট চিকিৎসকরা রোগী দেখে থাকেন বলে রোগীরা ভালো চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে— জানিয়েছেন ডা. আবুল কাশেম চৌধুরী।
ডার্মাটোলজিকেই কেন চিকিৎসার ক্ষেত্রে হিসেবে বেছে নিলেন— এমন প্রশ্নে ডা. আবুল কাশেম চৌধুরী বলেন, ‘চর্মরোগের রোগীরা অবহেলিত। প্রথমে তারা এ রোগকে গুরুত্ব দিতে চায় না। বাড়ির পাশের ডাক্তার কিংবা কারো মুখে মলমের কথা শুনে সেটি আক্রান্ত স্থানে লাগিয়ে থাকে। এতে রোগ আরও বেড়ে যায়। বর্তমানে যে ফাঙ্গাল ইনফেকশন বা ছত্রাক জাতীয় চর্মরোগের রোগী বেড়েছে তা এ কারণেই।’
তিনি বলেন, ‘চর্মরোগে উপযুক্ত চিকিৎসা দিতে হবে রোগীর। কারণ একজন মানুষের গায়ের চামড়ার পরিবর্তন দেখেই রোগের লক্ষণ বোঝা যায়। তাই স্কিন বা চামড়া দেখেই অনেক রোগের ডায়াগনোসিস সম্ভব।’
অবসরগ্রহণের পর দিনে দুই বেলা চট্টগ্রামের ল্যাবএইড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখবেন বলে জানান ডা. আবুল কাশেম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘সময়ের অভাবে অনেক রোগীর সিরিয়াল দেওয়া সম্ভব হয় না। রোগীরা আমাকে আশা করে। তাই রোগীকে বেশি সময় দেওয়ার কথা ভাবছি।
অবসরজীবনে ফের শিক্ষকতায় নিজেকে জড়াবেন কিনা সে ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি বলে জানান ডা. কাশেম। স্ত্রীর সাথে আলোচনা করেই তিনি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চান।
ডা. আবুল কাশেম চৌধুরী ব্যক্তিজীবনে এক মেয়ে ও এক ছেলের জনক। মেয়ে চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে পড়ছেন আর ছেলে ইস্পাহানী পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজে দশম শ্রেণির ছাত্র।
ব্যক্তিগত সন্তুষ্টির জায়গা বলতে গিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, ‘আমি কলেজে পোস্টগ্রাজুয়েট ও আনডার গ্রাজুয়েট অনেক শিক্ষার্থী রেখে এসেছি। আমি সবার শিক্ষক। চিকিৎসকের সাথে এ সম্মানটাই আমার সারা জীবনের অর্জন বলে মনে করি। আর ৩১ বছরের কর্মজীবনে সৎ ও সম্মানজনকভাবে দায়িত্ব পালন শেষে বিদায় নিতে পেরেছি এটা মানুষ হিসেবে ও চিকিৎসক হিসেবে আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া।’
সিপি