২ বছরেই আঙুল ফুলে কলাগাছ চট্টগ্রামের পিয়াল, চালচলনেও হঠাৎ ‘ফুটানি’
ফেসবুক গ্রুপ খুলে অবিশ্বাস্য প্রতারণা
‘দাদাভাই, আমাকে কিছু টাকা দিতে পারবে? কাল ভর্তির লাস্ট ডেইট। রাতেই পাঁচ হাজার টাকা না পেলে কাল ভর্তি হতে পারবো না।’ অথবা, ‘দাদা, গতকাল রাত ও আজ দুপুরে ভাত খাইনি, কিছু টাকা দিলে রান্না করে খেতে পারতাম’— এমনই হৃদয়ছোঁয়া ম্যাসেজ দিয়ে যে ছেলে দু’বছর আগেও মানুষের কাছ থেকে ধার করে চলতো, সেই ছেলের জীবনে এসেছে আমূল পরিবর্তন।
পরিবর্তন এতটাই হয়েছে যে, দুটি ফ্ল্যাট ভাড়ায় থাকার পাশাপাশি ছয়টি রুমেই ছিল স্মার্ট টিভি। সঙ্গে ঘরে ছিল ডাবল ডোরের ৮০ হাজার টাকা দামের ফ্রিজ। এছাড়া ছিল দুটো মোটরসাইকেল।
বলছিলাম চট্টগ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা, ‘কোটি টাকা মেরে’ পালানো কথিত ধর্মীয় বক্তা পিয়াল শর্মার কথা। করোনা মহামারীতেও যার ‘নুন আনতে পান্তা ফুরানো’র অবস্থা ছিল, সেই পিয়ালই দু’বছরের মাথায় হয়ে উঠল ‘বিজনেস টাইকুন’।
‘চেরিশ এগ্রো ফিড’ নামের কোম্পানির শেয়ার বিক্রির নামে অসংখ্য লোক থেকে অন্তত ১০ কোটি টাকা মেরে পরিবারসহ নিরুদ্দেশ হন পিয়াল শর্মা।
সর্বশেষ ২৭ ডিসেম্বর পিয়ালকে দেখা গিয়েছিল মোহরা এলাকায়। তারপর থেকেই পরিবারসহ নিখোঁজ তিনি। ধারণা করা হচ্ছে, ওইদিন রাতেই তিনি পালিয়ে যান।
দামি জিনিসে ভর্তি ঘর
চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁওয়ের মোহরা এলাকায় পাশাপাশি দুটি ফ্ল্যাট নিয়ে থাকতেন মা-বোন-স্ত্রীকে নিয়ে। হঠাৎ করে বড়লোক হয়ে যাওয়া পিয়ালের চালচলন এতটাই রাজকীয় ছিল যে, চার সদস্যের পরিবারের জন্য বসিয়েছেন ছয়টি এলইডি টিভি। দুই ফ্ল্যাটের চারটি বেড রুম ও দুই গেস্ট রুমে শোভা পেতো এই ছয় টিভি।
এছাড়াও প্রায় ৮০ হাজার টাকা দিয়ে ভিশন কোম্পানির ডাবল দরজার একটি ফ্রিজ নিয়েছেন। জানা গেছে, ফ্রিজ কিনতেও তিনি করেছেন ঠগবাজি। অন্যজনের জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে ডাউন্ডপেমেন্টে ফ্রিজটি কেনেন পিয়াল।
এছাড়াও ঘরে রয়েছে দামি ল্যাপটপ, ওয়াশিং মেশিনসহ প্রয়োজনীয় সকল জিনিসপত্র। সেইসঙ্গে তার হাতে শোভা পেতো বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দামি দামি মোবাইল।
চারদিন ধরে চলে বিয়ের অনুষ্ঠান
চেরিশ এগ্রো ফিডের চেয়ারম্যান হওয়ার ৮ মাস পর বিয়ে করেন পিয়াল। ‘জিরো থেকে হিরো’ হওয়া পিয়ালের ধুমধাম বিয়ের সাক্ষী হন চট্টগ্রামের উচ্চশ্রেণির হিন্দু নেতারাও। বিয়ের আগে টানা তিনদিন ধরে অনুষ্ঠানও করেছিলেন তিনি। বিয়ে নিয়ে এমন আহামরি কাণ্ড দেখে তার বিয়েকে ‘রাজার ছেলের বিয়ে’ বলেও আখ্যা দেন প্রতিবেশীরা।
টাকা আয়ে প্রতারণা
আত্মীয় ও বন্ধুদের ভাষ্যমতে, পিয়াল ছিলেন খুবই বাকপটু। নিমিষেই মানুষকে ‘কনভিন্স’ করার ক্ষমতা ছিল তার। ধর্মীয় সংগঠক হিসেবে ভালোই সুনাম ছিল পিয়ালের। সেই সুনামকে পুঁজি করে হিন্দু সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের থেকে নানান অজুহাতে নিতেন টাকা। এমন কয়েকটা ম্যাসেজ চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে এসেছে। যেখানে দেখা গেছে, পরীক্ষার ফরম ফিলআপের জন্য ৩ হাজার টাকা চেয়ে ম্যাসেজ দেন পিয়াল। আবার কখনও চালকেনার জন্য টার ধার নিতেন।
যদিও ভুক্তভোগীরা জানান, ধার হিসেবে টাকা নিলেও কখনো তা আর ফেরত দিতেন না পিয়াল।
এছাড়াও মানবিক কাজে সবসময় ‘অ্যাকটিভ’ থাকতেন পিয়াল। কখনও গরিব ছেলের পড়ালেখার খরচ, কখনও বয়স্ক লোকের চিকিৎসার কথা বলে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নিতেন তিনি। আর এই টাকার অল্প কিছু ব্যয় করলেও বেশিরভাগ ভরতেন পকেটে, এমন অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
প্রতারণার আরেক ধরন ‘টিম কল্পলোক’
পরিবারের কোনো সদস্য নাচ বা গানের শিল্পী না হলেও পিয়ালের ঘরে খোলা হয় ‘টিম কল্পোলোক’ নামের একটি সাংস্কৃতিক স্কুল। যেখানে নাচ, গান থেকে শুরু করে নানান সাংস্কৃতিক বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হতো। কয়েকটি বিভাগে এই স্কুলে অন্তত ১০০ জন শিক্ষার্থী ছিল।
জানা গেছে, মা, বোন ও স্ত্রী পরিচালিত এই স্কুলের প্রায়ই সকল শিক্ষার্থীর অভিভাবক থেকেও টাকা নিয়েছেন পিয়াল।
‘আমরা যেখানে আছি, খুব ভালো আছি’
পালিয়ে যাওয়ার আগে ও পরে প্রবাসী বাবাকে নিজেদের ভালো থাকার খবর জানাতে ভুল করেননি পিয়াল।
পিয়ালের একাধিক আত্মীয় জানান, ২৭ ডিসেম্বর রাতে পালিয়ে যাওয়া পিয়াল তার কুয়েতপ্রবাসী বাবাকে ভয়েস ম্যাসেজে জানান, ‘বাবা আমরা চলে যাচ্ছি, কোথায় যাচ্ছি জানি না; তোমার সঙ্গে পরে যোগাযোগ করবো।’
পিয়ালের নিরুদ্দেশের ঘটনার পর থেকেই আন্ডারগ্রাউন্ড হয়ে যান বাবা কাঞ্চন শর্মা। মোবাইল বন্ধ করে যোগাযোগের বাইরে থাকেন তিনি। এমনকি একইদেশে থাকা পিয়ালের জেঠাও কাঞ্চন শর্মার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না।
কিন্তু সপ্তাহখানেক পর আবার ফিরে আসেন পিয়ালের বাবা। নিজ থেকেই কয়েকজন ভুক্তভোগীকে ফোন করে সহমর্মিতা জানান। পিয়ালের এক আত্মীয়কে তার বাবা ফোন করে জানান, পালিয়ে যাওয়ার পাঁচদিন পর আবারো ম্যাসেজ পাঠায় পিয়াল। সেখানে বলা হয়, ‘আমরা যেখানে আছি, খুব ভালো আছি বাবা। তুমি টেনশন করিও না।’
তবে পিয়াল কোথায় আছেন—জানতে চাইলে ওই আত্মীয়কে পিয়ালের বাবা বলেন, ‘কই আছে আমি জানি না বাপু।’
মূলত ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করে দেওয়ার জন্য ওই আত্মীয়কে পিয়ালের বাবা ফোন করেন বলে জানা যায়।
এখনও দেশে যোগাযোগ রয়েছে পিয়ালের
পিয়াল সপরিবারে নিরুদ্দেশ হলেও তার সঙ্গে বাংলাদেশের ২ বন্ধু ও কয়েকজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ থাকার বিষয়টি জানান পিয়ালের এক প্রতিবেশী।
ওই প্রতিবেশী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পিয়াল নিয়মিত তার বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এখানকার পরিস্থিতি জানতে চায়।’
প্রতিবেশীর ধারণা, টাকা আত্মসাৎ, হুন্ডি করে বিদেশ পাচার থেকে শুরু করে পিয়ালকে দেশের বাইরে পাঠানোর মতো কাজে সহযোগিতায় তার এক ‘বন্ধু’র হাত রয়েছে। সেই বন্ধুটিও হঠাৎ করে বড়লোক হয়ে গেছে।
ব্যবসা করে বড়লোক হতে চেয়েছিলেন পিয়াল
চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা পাশ করেন পিয়াল। তিনি এই রেজাল্টে জীবনে ভালো কিছু করতে পারবে না, এমন চিন্তা থেকে উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করেন। এজন্য বিভিন্ন ধরনের টকশো, বই ও ইউটিউবে সময় দিতেন বলে জানান পিয়ালের সাংগঠনিক এক সহযোদ্ধা।
সেইসঙ্গে বড়লোক হওয়ার বাসনা কাজ করতো পিয়ালের মনে। কিভাবে কমসময়ে বড়লোক হওয়া যায়, সে বিষয়ে ইউটিউবে প্রচুর ভিডিও দেখতেন বলে জানান পিয়ালের ওই সহযোদ্ধা।
পরিবারে ঝগড়াঝাটি ছিল নিত্যসঙ্গী
পিয়ালের সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া হতো তার স্ত্রীর। তবে কি কারণে ঝগড়া হতো, তা জানতে চাইলেও পিয়ালের মা চেপে যেতেন। পিয়াল পালিয়ে যাওয়ার পর তার বাবা এক আত্মীয়কে জানান, বউ কথা না শোনায় পিয়াল একবার ফাঁস খেতেও চেয়েছিলেন।
এছাড়া পালানোর এক সপ্তাহ আগে পিয়াল ও তার পরিবারকে দুশ্চিন্তায় থাকতে দেখেছেন প্রতিবেশীরা। কি কারণে দুশ্চিন্তা—জানতে চাইলে এক আত্মীয়কে পিয়ালের মা জানান, পিয়াল ও বউয়ের মধ্যে ঝগড়া নিয়েই পারিবারিক অশান্তি চলছে।
দিল্লি হয়ে ইউরোপ পালানোর চেষ্টা
বাংলাদেশ ও ভারতে থাকা পিয়ালের আত্মীয়রা জানান, ভারতে প্রবেশের পর পিয়াল তার পরিবারকে নিরাপদ জায়গায় রেখেছেন। এরপর তিনি গেছেন দিল্লি। সেখান থেকে ইউরোপের কোনো দেশে পাড়ি জমাবেন।
এই পর্যন্ত পিয়ালের বিরুদ্ধে প্রায় অর্ধডজন অভিযোগ জমা পড়েছে থানায় এবং আদালতে। তবে এখন পর্যন্ত এই ঘটনার কোনো কুল-কিনারা করতে পারেনি পুলিশ।
ডিজে