২৮০ কোটি টাকা মেরে চট্টগ্রামের মোর্শেদ আমেরিকায় উধাও, তালা ঝুলছে তিন গার্মেন্টসে

শেয়ারবাজার থেকেও তুলেছিলেন ২৯৩ কোটি টাকা

সম্ভাবনাময় তকমা নিয়েই পোশাকের ব্যবসা শুরু করেছিলেন তিনি। সম্ভাবনা জাগিয়েই একসময় হয়ে ওঠেন বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানার মালিক। সেই ব্যবসা যখন জমে ওঠে, তখনই হঠাৎ করে ছন্দপতন শুরু হতে থাকে। এমনই ছন্দপতন যে, তিনটি ব্যাংক এখন ২৮০ কোটি টাকার ঋণের টাকা পেতে হন্যে হয়ে খুঁজছে চট্টগ্রামের এই ব্যবসায়ীকে। নাম তার মোহাম্মদ মোর্শেদ। এই লোকের নামের পাশে এখন জ্বলজ্বল করছে গুণে গুণে ১৪টি মামলা। চেক বাউন্সিংয়ের ১২টি মামলায় জারি হয়েছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও।

গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে ঠিক, কিন্তু তার অনেক আগেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন মোর্শেদ। এখন তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই আছেন পলাতক অবস্থায়। ২০১৮ সালের শুরুতে তৃতীয় স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে আমেরিকায় পাড়ি জমান ব্যবসায়ী মোর্শেদ। তার সবগুলো পোশাক কারখানাতেই ঝুলছে তালা।

দ্রুত উত্থান, হঠাৎ পতন

চট্টগ্রাম নগরীর মেহেদীবাগ এলাকার বাসিন্দা মোর্শেদ পারিবারিক ব্যবসার সূত্র ধরেই ঢোকেন পোশাক ব্যবসায়। এই পরিবারের মালিকানায় ছিল নামি কয়েকটি পোশাক শিল্পপ্রতিষ্ঠান— কাশ গার্মেন্টস, ক্যাসন গার্মেন্টস, হেরাল্ড গার্মেন্টস।

তবে মোর্শেদ বেশিদিন থাকেননি যৌথ পারিবারিক ব্যবসায়। ১৯৯৫ সালে পারিবারিক ব্যবসার সঙ্গে সম্পর্ক ছেড়ে একাই শুরু করেন সিএন্ডএ টেক্সটাইলস। অবশ্য মোর্শেদ নিজে সেই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে থাকলেও বাবা সেকান্দার মিয়া হন চেয়ারম্যান আর ভাই মোহাম্মদ আরশাদ পরিচালক।

শুরুতে সিএন্ডএ টেক্সটাইলসের উন্নতি ঘটছিল দ্রুতই। সেই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় মোর্শেদ একে একে হয়ে ওঠেন আরও কয়েকটি পোশাক কারখানার মালিক। এর মধ্যে রয়েছে ইফকো গার্মেন্টস এবং সামরোজ গার্মেন্টস।

এ সময়ই হঠাৎ মোর্শেদের ব্যবসায় ছন্দপতন হতে শুরু করে। তিনি নিজেও অজানা কোনো কারণে ব্যবসা থেকে মনোযোগ হারাতে থাকেন। ব্যবসায় আচমকা লালবাতির আলো জ্বলতে শুরু করে। ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণও আর ফেরত দিতে পারেন না তিনি। ২০১৫ সালের পর ব্যবসা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন মোর্শেদ। তার ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন, মূলত পারিবারিক বিবাদের কারণেই তিনি বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যান।

টাকা উড়েছে ভোগবিলাসে

মোর্শেদকে কাছ থেকে দেখা ব্যাংকাররা বলছেন, ঋণের টাকা তিনি উড়িয়েছেন ভোগবিলাসে। মোর্শেদের প্রথম স্ত্রী চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গিবাজারের দোভাষ পরিবারের মেয়ে। পরে তিনি বিয়ে করেন তার সম্বন্ধীর স্ত্রীকে। সবশেষ ঢাকা ব্যাংকে কর্মরত এক নারী ব্যাংকারের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান। তৃতীয় এই স্ত্রীকে নিয়েই মোর্শেদ তিন বছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান।

এভাবে ভোগবিলাস ও পারিবারিক টানাপড়েনে ব্যবসায় যখন লালবাতি জ্বলার দশা, তখনই মোর্শেদ নেন ভিন্ন পথ। ২০১৫ সালে সিএন্ডএ টেক্সটাইলসকে শেয়ারবাজারে নিয়ে যান। সেখানে শেয়ার ছেড়ে ওই কোম্পানির জন্য সংগ্রহ করেন ২৯৩ কোটি টাকা। তবে সিএন্ডএ টেক্সটাইলসের ব্যবসা বাড়ানোর কথা বলে শেয়ারবাজার থেকে এই বিপুল পরিমাণ টাকা সংগ্রহ করলেও সেই টাকা মোর্শেদ আর কোম্পানিতে ব্যয় করেননি।

কালুরঘাটে বিরান কারখানা

শেষ পর্যন্ত মাত্র একবছর পর, ২০১৬ সালের শেষের দিকে মোর্শেদের গড়া সিএন্ডএ টেক্সটাইলসই নয় কেবল, আরও দুটি প্রতিষ্ঠান ইফকো গার্মেন্টস ও সামরোজ গার্মেন্টসও কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।

বুধবার (৩ ফেব্রুয়ারি) চট্টগ্রামের কালুরঘাট শিল্প এলাকায় সিএন্ডএ গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ের গেইটের বাইরে এক লোককে বসে থাকতে দেখা গেছে। সেই অফিসের বাইরের দেয়ালগুলোই বলে দিচ্ছিল, বহুদিন ধরে এই অফিসে লোকজনের আসা-যাওয়া নেই। চারদিক ভরে ওঠেছে লতাপাতা আর আগাছায়।

পাশের কারখানার নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় কিছু লোক আর ইফকো গার্মেন্টসের কর্মীদের অনেকে বকেয়া পাওনা না পেয়ে কারখানার যন্ত্রপাতি ছাড়াও এমনকি দরজা-জানালা পর্যন্ত খুলে নিয়ে গেছে।

চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানার ওসি নেজাম উদ্দিন নিশ্চিত করেছেন, মোরশেদের বিরুদ্ধে থানায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। তবে তিনি পলাতক।

টাকা আদায়ে গা ছাড়া মনোভাব ব্যাংকের

দেশে থাকতেই অনেক বছর ধরে ঋণ শোধ করছিলেন না মোর্শেদ, কিন্তু ব্যাংকগুলোকে সেটা নিয়ে তেমন তৎপর হতে দেখা যায়নি। চট্টগ্রামভিত্তিক এক নামি শিল্পগ্রুপের কর্ণধারের সঙ্গে মোর্শেদের রয়েছে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার সম্পর্ক। এই শিল্পগ্রুপের মালিকানায় রয়েছে একাধিক ব্যাংক। মোর্শেদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোর গা ছাড়া মনোভাবের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল এটিই— মনে করছেন কোনো কোনো ব্যাংকার।

ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, সিএন্ডএ টেক্সটাইলসের কাছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পাবে ১৩৯ কোটি টাকা। সামরোজ গার্মেন্টসের কাছে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক পাবে ৭৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে ইফকো গার্মেন্টসের কাছ থেকে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক পাবে ৬২ কোটি টাকার ঋণ।

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও জুবিলি রোড শাখার ব্যবস্থাপক আবু হেনা নাজিম উদ্দিন সামরোজ গার্মেন্টসকে ‘পুরনো ক্লায়েন্ট’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘মোর্শেদের লেনদেন শুরুর দিকে ভালোই ছিল। কিন্তু পরে তিনি ঋণ পরিশোধে ঢিলেমি শুরু করলেন। শুনেছি তিনি ইতিমধ্যে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। আমরা অতীতে বহুবার ঋণের টাকা আদায়ের চেষ্টা করেছি। সেই চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর আমরা তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছি।’

আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক আমিনুর রহমান বলেন, ‘মোর্শেদের কোম্পানি ঋণ নিয়েছে এবং কাপড় রপ্তানি করে মুনাফা করেছে। কিন্তু পরে আর ঋণ পরিশোধ করেনি। তার কারখানার সরঞ্জাম এবং কালুরঘাট শিল্পাঞ্চলের চারটি শিল্প প্লট ব্যাংকের কাছে বন্ধক রয়েছে।’

এই ব্যাংকার বলেন, ‘মোর্শেদ ঋণ নিয়ে সেই টাকা অপচয় করেছেন।’

ঋণের বিশাল পাহাড় কে বইবে?

মোর্শেদের মালিকানাধীন সামরোজ গার্মেন্টস ২০০৬ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ঋণ সুবিধা নেয় কাঁচামাল রপ্তানি ও ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের নামে। শুরুতে ভালো থাকলেও ২০১৫ সালের পর থেকে ঋণ পরিশোধে গড়িমসি শুরু করেন মোর্শেদ। এমন অবস্থায় ঋণ টাকা আদায়ের চেষ্টা হিসেবে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের জুবলী রোড শাখা ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মোর্শেদের প্রতিষ্ঠানটিকে ১৪ বার চিঠি দেয়। কিন্তু তাতেও কোনো ফল আসেনি।

এমন পরিস্থিতিতে ২০২০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর মোর্শেদের মালিকানাধীন তিনতলা একটি ভবনসহ ১৭ দশমিক ৭৫ শতক বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে তোলে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। কিন্তু সম্পত্তিগুলো মোর্শেদের দখলে থাকা এবং নিলামে কোনো ক্রেতা পাওয়া না যাওয়ায় সেখানেও ব্যর্থ হয় ব্যাংকটি। এরপর গত ৮ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতে একটি মামলা দায়ের করা হয়। এই মামলায় সামরোজ গার্মেন্টসের কাছে ৭৮ কোটি ৫৩ লাখ ৭২ হাজার ১১০ টাকা পাওনা রয়েছে জানায় স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক।

তবে এর আগে ২০১৮ সালে সামরোজ গার্মেন্টসের বিরুদ্ধে দুটি এনআই অ্যাক্ট মামলাও দায়ের করে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক— যা এখন শুনানি পর্যায়ে রয়েছে।

চট্টগ্রামের কালুরঘাট শিল্প এলাকায় রয়েছে মোরশেদের আরেকটি প্রতিষ্ঠান ইফকো গার্মেন্টস। ২০১০ সালে আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে ঋণ সুবিধা নেয় প্রতিষ্ঠানটি। সেই ঋণ শোধ হয়নি গত ১১ বছরেও। টাকা আদায়ে ব্যর্থ হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মোর্শেদের বিরুদ্ধে ১১টি মামলা দায়ের করে এই ব্যাংক। এর মধ্যে ২০১৭ সালের বিভিন্ন সময়ে এনআই অ্যাক্টে দায়ের করা হয় ১০টি মামলা। ওই বছরের ১০ জানুয়ারি দায়ের করা হয় অর্থঋণ মামলা। ইফকো গার্মেন্টসের কাছে আল আরাফাহ ব্যাংকের পাওনা ৬২ কোটি ৩৯ লাখ ৪৯ হাজার ৮৯৩ টাকা।

২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা থেকেও ঋণ সুবিধা নেয় সিএন্ডএ টেক্সটাইল। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির কাছে ব্যাংকটির পাওনা ১৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৩৪ কোটি টাকা ইতোমধ্যে বিএল (বেড এন্ড লস) শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে।

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, ‘ঋণের বিপরীতে কালুরঘাট শিল্পনগরীতে সিএন্ডএ টেক্সটাইলের কারখানাগুলোর যন্ত্রপাতিসহ চারটি প্লট বন্ধক হিসেবে রয়েছে। তবে বিসিক থেকে বরাদ্দ নেওয়া এসব প্লট ও যন্ত্রপাতি বিক্রি বা কাউকে হস্তান্তর করে পাওনার এক-তৃতীয়াংশও উদ্ধার হবে না।’

শেয়ারবাজারেও অনিশ্চয়তায় বিনিয়োগকারীরা

এদিকে সিএন্ডএ টেক্সটাইলের কর্ণধার মোর্শেদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছে শেয়ারবাজারে থাকা প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারহোল্ডাররা।

২০১৫ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় সিএন্ডএ টেক্সটাইল। ওই সময় প্রতিষ্ঠানটি ২৩ কোটি ৯৩ লাখ ১৬ হাজার শেয়ারের বিপরীতে পুজিঁবাজার থেকে প্রায় ২৯৩ কোটি টাকা তুলে নেয়। এই প্রতিষ্ঠানটি সর্বশেষ ২০১৬ সালে বিনিয়োগকারীদের ১০ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ট দিয়েছিল।

সিপি

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড অবলম্বনে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!