চট্টগ্রামের পুরনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খাতুনগঞ্জভিত্তিক ইলিয়াছ ব্রাদার্স লিমিটেডের (এমইবি গ্রুপ) পাঁচ পরিচালককে এবার ১ বছরের কারাদণ্ড ও ২৫ কোটি টাকা অর্থদণ্ড করা হয়েছে। ওয়ান ব্যাংকের ২৫ কোটি টাকার চেক প্রতারণা মামলায় এই দণ্ড দেওয়া হল।
এই পাঁচজন হলেন ইলিয়াছ ব্রাদার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামসুল আলম, তার স্ত্রী পরিচালক কামরুন্নাহার বেগম, ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বোন পরিচালক তাহমিনা বেগম এবং চেয়ারম্যান মো. নুরুল আবছার ও পরিচালক মো. নুরুল আলম।
বুধবার (২০ এপ্রিল) চট্টগ্রামের তৃতীয় যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক কাজী মিজানুর রহমান এ আদেশ দেন।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, ওয়ান ব্যাংকের হিসাব থেকে দেওয়া একটি চেক প্রদান করা হলেও ২০১৩ সালের ২২ মে ওই চেকটি অপর্যাপ্ত তহবিলের কারণে ডিজঅনার হয়। পরে একই তারিখে নালিশকারী অর্থাৎ ওয়ান ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাদের নিয়োজিত আইনজীবীর মাধ্যমে আসামিদের বরাবর আইনি নোটিশ পাঠান। আসামিরা ওই নোটিশ ২০১৩ সালের ২৫ মে গ্রহণ করেন।
সেই নোটিশ পাওয়ার পরও আসামিরা চেকের টাকা পরিশোধ না করায় ব্যাংক ২০১৩ সালের ১০ জুলাই মামলা দায়ের করে।
এর আগে গত ৬ মার্চ ন্যাশনাল ব্যাংকের দায়ের করা এক অর্থঋণ জারি মামলায় চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের বিচারক মুজাহিদুর রহমান ইলিয়াছ ব্রাদার্স (এমইবি) গ্রুপের এই পাঁচ মালিকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বহাল রাখার আদেশ দেন।
জানা গেছে, ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের খাতুনগঞ্জ শাখা ইলিয়াছ ব্রাদার্সের এই পরিচালকের কাছ থেকে ১৮৩ কোটি ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৫৭৩ টাকা পাবে। এ নিয়ে ২০১২ সাল থেকে ব্যাংকটি একাধিকবার দেনদরবার করলেও ঋণের সেই টাকা আর পরিশোধ করেনি তারা। এরপর ন্যাশনাল ব্যাংক এ নিয়ে মামলা যাওয়ার পর ২০২১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের বিচারক ওই পাঁচ পরিচালককে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেন। সেই আদেশই রোববার (৬ মার্চ) পুনর্বহাল করা হল।
চট্টগ্রামের মেসার্স ইলিয়াছ ব্রাদার্সের খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকে ২৮০ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকে ২৭০ কোটি, ইস্টার্ন ব্যাংকে ৭৩ কোটি, এবি ব্যাংকে ৬২ কোটি, ইসলামী ব্যাংকে ৬৩ কোটি, মার্কেন্টাইল ব্যাংকে ৫৫ কোটি, সিটি ব্যাংকে ৫৫ কোটি, ব্যাংক এশিয়ায় ৩৯ কোটি, ওয়ান ব্যাংকে ৩০ কোটি, স্টান্ডার্ড ব্যাংকে ২৪ কোটি, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে ১৮ কোটি, পুবালী ব্যাংকে ৭ কোটি এবং এক্সিম ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ৪ কোটি টাকা।
এর আগে গত বছরের ১৮ নভেম্বর ইলিয়াছ ব্রাদার্স লিমিটেডের (এমইবি গ্রুপ) এই পাঁচ পরিচালককে ৫ মাসের কারাদণ্ডে দণ্ড দেন চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের বিচারক মুজাহিদুর রহমান। জানা গেছে, উত্তরা ব্যাংক লিমিটেড আগ্রাবাদ শাখা থেকে ইলিয়াছ ব্রাদার্সের নেওয়া ৪৫ কোটি ৬৪ লাখ ৪৪ হাজার ১৯৮ টাকা ঋণের টাকার জন্য মামলাটি করা হয়। ওই মামলায় ইলিয়াছ ব্রাদার্স লিমিটেডের ৫ পরিচালককে ৫ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
এর আগে গত বছরের ২৩ জুন সাউথইস্ট ব্যাংকের ৭৫ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় মেসার্স ইলিয়াছ ব্রাদার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. শামসুল আলমসহ ৫ পরিচালককে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন আদালত। সাউথইস্ট ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার ৭৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মেসার্স ইলিয়াছ ব্রাদার্সের এমডিসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে ২০১২ সালে একটি অর্থঋণ মামলা (মামলা নম্বর ৫৪/১২) হয়। এ মামলায় তখন রায়ও ঘোষণা হয়। রায়ে ৬০ দিনের মধ্যে টাকা পরিশোধের কথা বলা হয়। কিন্তু তারা তা করেনি। একপর্যায়ে সাউথইস্ট ব্যাংক ২০১৩ সালে টাকা ফেরত পেতে একটি জারি মামলা (৭৭/১৩) দায়ের করে। ওই মামলায় তারা আদালতে হাজিরও হন। কিন্তু পরে হাজির হওয়া বন্ধ করে দেন। টাকাও ফেরত দিচ্ছিল না।
চট্টগ্রামে অগ্রণী ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে ইলিয়াছ ব্রাদার্সের মাধ্যমে জামানত ছাড়াই ইন্দোনেশিয়ায় মালামাল কেনার নামে ১৫৫ কোটি ৪৪ লাখ ৫৩ হাজার টাকা ঋণের টাকা মেরে দেওয়ার ঘটনায় ২০১৮ সালের মে মাসে দুর্নীতি দমন কমিশন একটি মামলা করে। ইলিয়াছ ব্রাদার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামসুল আলমসহ মোট ১১ জনের বিরুদ্ধে নগরের ডবলমুরিং থানায় ওই মামলা দায়ের করেন দুদকের উপ-পরিচালক সামছুল আলম।
২০১৯ সালের ২৫ নভেম্বর অর্থ আত্মসাতের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ইলিয়াছ ব্রাদার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামসুল আলমকে গ্রেপ্তার করে ইপিজেড থানা পুলিশ। প্রায় ১৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে শামসুল আলমের বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে দুটি মামলা দায়ের করেছিল দেশের অন্যতম শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠী মেঘনা গ্রুপ। ওই মামলা দুটিতেও সাজা হয় শামসুল আলমের।
শামসুল আলম চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি ছিলেন। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালী-বাকলিয়া আসন থেকে বিএনপি মনোনয়নে নির্বাচন করে পরাজিত হন। এরপর কিছুদিন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে এখনও তার নাম রয়েছে।
সিপি