১৮ মাসে ১৮০ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা করোনাকালের অবসাদে

২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সীরাই বেশি আত্মহত্যাপ্রবণ

চিরকুটে লেখা ছিল— ‘আমার মৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী নয়, আমার বেঁচে থাকার কোন ইচ্ছা নেই, তাই আমি এই সিন্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি, ডারউইন বলেছিলেন- Survival for the fittest. but I not even fit. আমার জন্য কেউ কখনো কষ্ট পেয়ে থাকেন পারলে ক্ষমা করে দিয়েন। আম্মু আমাকে মাফ করে দিয়েন, মিলনের (ছোট ভাই) খেয়াল রাখিয়েন। আব্বু আমাকে সফল করার জন্য অনেক কিছু সহ্য করেছেন, আমি পারিনি তাই ক্ষমাপ্রার্থী।’

গত ৫ মার্চ এমন এক চিরকুট খাটের ওপর রেখে ফ্যানের সঙ্গে একটি রেশমি চাঁদরে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র নাইমুল হাসান মিশন (২১)। পরিবার জানায়, খাগড়াছড়ির রামগড়ের বাসিন্দা মিশন বেশ কিছুদিন ধরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন।

এভাবে শুধু করোনার সময়েই ১৫ মাসে বাংলাদেশে ১৫১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। আবার অন্য এক হিসাবে, গত বছরের মার্চ থেকে এ বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৯ মাসে ১৮০ শিক্ষার্থী আত্মঘাতী হয়েছেন।

তরুণদের দিয়ে পরিচালিত একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ‘আঁচল ফাউন্ডেশন বলছে, গত বছরের মার্চ থেকে শুরু করে জুন পর্যন্ত সারাদেশে ১৫১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে এই সংখ্যা হলেও বাস্তবে তা আরো বেশি হতে পারে।

সংগঠনটির প্রধান তানসেন রোজ গণমাধ্যমকে জানান, গত মার্চ মাসে তারা আরেকটি জরিপ প্রকাশ করেছিলেন। তাতে দেখা গেছে করোনার এক বছরে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছে তরুণ-তরুণী। ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে তাদের বয়স। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে তারা দেখেছেন, অনিশ্চয়তাই প্রধান কারণ। শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় হতাশায় আক্রান্ত হন। আর চাকরি চলে যাওয়াও অনেক তরুণের হতাশার কারণ।

যেসব শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন তাদের মধ্যে ৭৩ জন স্কুল শিক্ষার্থী, ২৭ জন কলেজ শিক্ষার্থী, ২৯ জন মাদ্রাসার এবং ৪২ জন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী রয়েছেন। গত মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন।

গত এক দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত শিক্ষার্থী ও এক শিক্ষক আত্মহত্যা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের দোতলায় একটি কাউন্সেলিং কেন্দ্র করা হলেও তার কার্যক্রম এখন বন্ধ।

আত্মহত্যাই শুধু নয়, আত্মহত্যার চেষ্টা করেও অনেকে বিফল হয়েছেন। পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল না পাওয়ায় গত ৭ সেপ্টেম্বর আত্মহত্যার চেষ্টা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী দেলোয়ার হোসেন। বিশ্ববিদ্যালয় জিমনেশিয়ামের ওই শিক্ষার্থী নিজের মোবাইল ভেঙে কাঁচ দিয়ে নিজের হাত কেটে ফেলার চেষ্টা করে একপর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। চবি মেডিকেল সেন্টারের চিফ মেডিকেল অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মোহাম্মদ আবু তৈয়ব জানান, পরীক্ষায় সে ফার্স্ট ক্লাস না পাওয়ায় মোবাইলের কাঁচ দিয়ে হাতের কিছু অংশ কেটে ফেলে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩ জন বর্তমান এবং একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০ জন কাউন্সেলর পার্টটাইম এবং একজন স্থায়ীভাবে কাজ করলেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সাড়া মেলে না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গত এক দশকে ১১ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তার মধ্যে ছয়জন মেয়ে ও পাঁচজন ছেলে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে দুজন সাইকোলজিস্ট ও একজন কাউন্সেলিং অফিসার রয়েছেন।

গত দেড় মাসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। গত পাঁচ বছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপক্ষে ছয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চারজন মনোবিজ্ঞানীর তত্ত্বাবধানে বর্তমানে ৬৫০ শিক্ষার্থী চিকিৎসা নিচ্ছে। এদের মধ্যে ২১৭ জন একাধিকবার আত্মহত্যার প্রস্তুতি নিয়েছিল। প্রতিদিন গড়ে ৯ জন শিক্ষার্থী চিকিৎসা নিতে আসে সেখানে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!