১৬ নারী চট্টগ্রাম রেলের স্টেশনমাস্টার, মধ্যরাতেও চলে নির্ঘুম ডিউটি
নারী এখন শুধু সংসার, স্বামী ও সন্তান সামলান না—প্রশাসন, পুলিশ থেকে শুরু করে বিমান ও ট্রেন চালানো, এমনকি খেলার মাঠেও সমানতালে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তারা। সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করে পুরুষের সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ-বিদেশে। তেমনই রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল চট্টগ্রাম বিভাগে ১৬ নারী সামলাচ্ছেন রেলস্টেশনের দায়িত্ব। ঠান্ডা মাথায় ট্রেন অপারেশন, সিগন্যাল মেনটেইন থেকে শুরু করে পাস থ্রো সিগন্যাল—সবই করছেন তারা। রাত জেগে ডিউটি ও ছুটি ছাড়াই মাসের পর মাস কাজ করছেন অনেকে। অথচ অনেক স্টেশনে নেই রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি) ও রেল পুলিশের নিরাপত্তার চাদর। এরপরও চ্যালেঞ্জিং এ পেশায় হাসিমুখে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তারা।
এদের একজন ফতেয়াবাদে রেলস্টেশনে কন্ট্রোলার হিসেবে কর্মরত নাহিদা হোসেন। তবে তিনি এর আগে চট্টগ্রামের পটিয়ার ধলঘাট স্টেশনের মাস্টার ছিলেন। গত বছরের জুলাই আন্দোলনের সময় কারফিউর মধ্যে যখন সবাই ঘরবন্দি তখন তিনি সামলেছেন স্টেশনের দায়িত্ব। তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘স্টেশনমাস্টারের চাকরিটা অনেকটা প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে করার মতো। আমি এখনও ডিউটিতে। আমাদের চাকরিতে কোনো শুক্রবার নেই। ঈদের দিনেও আমাদের চাকরি করতে হয়। এটাই আমাদের চাকরির নেচার।’
তিনি বলেন, ‘আমার চার বছরের একটি মেয়ে সন্তান আছে। আমার বাচ্চার অভিজ্ঞতা যদি বলি, ধলঘাট যখন রানিং স্টেশন ছিল, আমার বাচ্চাকে তখন ব্রেস্টফিডিং করাতে হতো। তাকে নিয়ে আমি স্টেশনে যেতাম আর আসতাম। একদিন আমি ভোর ৫টায় কনকনে শীতে তাকে নিয়ে বের হয়েছিলাম। এটি আমার খুব খারাপ লেগেছিল।’
নিরাপত্তার বিষয়ে নাহিদা বলেন, ‘আমাদের প্রচুর লোকবল সংকট। প্রশাসন চাইলেও আমাদের ওইরকম নিরাপত্তা দিতে পারছে না। বিগত চার মাসে আমার একদিনও ছুটি ছিল না, প্রতিদিন আমার ১২ ঘণ্টা করে অফিস করতে হয়েছে। একজন নারী হিসেবে আমার জন্য এটি খুবই কষ্টের ছিল। ধলঘাটে যখন ছিলাম আমি, তখন আশপাশের প্রতিবেশীদের মধ্যে থেকে কাউকে স্টেশনে এনে বসিয়ে রাখতাম। ধলঘাট গ্রামের মতো জায়গায় সন্ধ্যার পর আসলে একটা নারীর খুবই অনিরাপদ বোধ হয়। আমার হাজব্যান্ডও রেলে চাকরি করে। আমি ডিউটিটা এভাবে নিতাম, যেন আমার স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি। ফতেয়াবাদেও একই অবস্থা, সন্ধ্যা পর আমি দরজা বন্ধ করে নিজের মতো করেই কাজ করি। যেহেতু আমার পিম্যান পুরুষ থাকে, ফলে আমি একটু নিরাপদ মনে করি। তবে ধলঘাট এবং ফতেয়াবাদে আরএনবি ও কোনো রেল পুলিশ নেই।’
নাহিদা হোসেন ছাড়া অপর ১৫ নারী স্টেশনমাস্টার ও সহকারী স্টেশনমাস্টার হলেন—চট্টগ্রাম কেবিনে কর্মরত (গ্রেড-৩) স্টেশন মাস্টার তানজিনা শাহনাজ, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের (গ্রেড-৩) কাজী ওয়াহিদা রহমান, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের নূরজাহান বেগম (গ্রেড-৪), ষোলশহরের (গ্রেড-৪) শিরিন আক্তার, সরকারহাটের (গ্রেড-৩) রোজিনা আক্তার, পটিয়ার সহকারী স্টেশন মাস্টার প্রেমা বড়ুয়া, পাহাড়তলী কন্ট্রোলের সহকারী স্টেশন মাস্টার আলেয়া বেগম, ডিটিও চট্টগ্রাম দপ্তরের সহকারী স্টেশন মাস্টার ফারজানা আক্তার।
এছাড়া আরও আছেন—ঝাউতলার সহকারী স্টেশনমাস্টার (বর্তমানে আরএসএম) আতিকা আক্তার, রিলিভিং স্টেশন মাস্টার (আরএসএম-গ্রেড-৩) তান্নি বড়ুয়া, জানআলী হাটের (গ্রেড-৪) তানিয়া আক্তার, ফতেয়াবাদের (গ্রেড-৪) আসমা আক্তার, রিলিভিং স্টেশনমাস্টার ফারজানা আক্তার, চাঁদপুরের সহকারী স্টেশন মাস্টার নাজমুন নাহার এবং চট্টগ্রাম জংশন কেবিনের সহকারী স্টেশন মাস্টার শামসুন নাহার।
জানা গেছে, রেলে ২০০৪ সালে প্রথমবারের মতো দুই নারীকে সহকারী স্টেশনমাস্টার নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০০৫ সালের নিয়োগ দেওয়া হয় ৫ নারীকে। এরপর ২০১৬ সালের জুলাই মাসে নিয়োগ দেওয়া ২৫৭ জন স্টেশন মাস্টারের মধ্যে ৩৭ জন নারীও ছিলেন। চট্টগ্রাম বিভাগে নারী-পুরুষ মিলে স্টেশনমাস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ১৫২ জন, এদের মধ্যে আছেন ১৬ জন নারী।
তবে নারী স্টেশনমাস্টারদের মতে, রেলের লোকবল সংকট দূর করা ও নিরাপত্তার বিষয়টিতে আরও গুরুত্ব দেওয়া দরকার। নারী হিসেবে এ চ্যালেঞ্জিং পেশায় যেহেতু রাতেও শিফটিং ডিউটি পালন করতে হয়, তাই রাতের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও জোরদার করা দরকার।
চট্টগ্রামের ঝাউতলার স্টেশনমাস্টার আতিকা বেগম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘২০১৬ সাল থেকে চাকরি করছি। ঝাউতলার বর্তমান কার্যক্রম বন্ধ হওয়ায় আমাকে আপাতত আরএসএম করা হয়েছে। আমরা আসলে চ্যালেঞ্জিং জব করি। এখানে নাইট ডিউটি আছে। ব্রাঞ্চ লাইনে সমস্যা নেই, কিন্তু ষোলশহর স্টেশন, চট্টগ্রাম স্টেশন, জংশন কেবিনের মতো স্টেশনে নাইট ডিউটি অবশ্যই করতে হয়। নাইট ডিউটি করতে গিয়ে অনেক প্রতিবন্ধকতা, যেমন—জংশন কেবিনে নাইট ডিউটি শুরু হয় রাত ১০টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত। রাতের ১০টায় যখন একজন মেয়ে বাসা থেকে বের হবে তখন রাস্তাঘাটে ওইরকম সিকিউর ফিল করা যায় না। এই চাকরিতে মেয়েদের অংশগ্রহণ তুলনামূলক কম। এছাড়া এটি শিফটিং জব। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ, এখানে মনোযোগ গুরুত্বপূর্ণ। যদি একবার সিগন্যাল ভুল হয় তাহলে কতগুলো মানুষের জীবন শঙ্কায় পড়ে।’
তিনি বলেন, ‘মেয়েদের অনেককিছু সামলাতে হচ্ছে। বাসা, বাচ্চা, সংসার সামলে তারপর চাকরিতে আসতে হচ্ছে। এখানে ৯-৫টা ডিউটি না। এখান শিফটিং ডিউটি। প্রশাসন যদি আরেকটু হেল্পফুল হয়, নিরাপত্তাটা যদি আরও বেশি নিশ্চিত করে তাহলে ভালো হয়।’
চট্টগ্রাম কেবিনের স্টেশনমাস্টার তানজিনা শাহনাজ বলেন, ‘২০১৬ সালের ২ আগস্ট আমি চাকরিতে যোগ দিই। এখানে আমাদের শিফটিং ডিউটি করতে হয়। স্টেশন সবগুলোতে তো নিরাপত্তা ব্যবস্থা সবসময় এক রকম থাকে না। রাতের ডিউটি তো সবার জন্য একই রকম। আমরা নারী হিসেবে যেরকম অনেকে বলে, বিশেষ সুযোগ সুবিধা পাওয়ার কথা—আসলে ওইরকম না। চাকরির ক্ষেত্রে পুরুষরা যেমন, নারীরাও ঠিক তেমন। ডিউটির টাইমিংও সবার জন্য সমান।’
ক্যান্টনমেন্ট রেল স্টেশনমাস্টার শিরিন আকতার বলেন, ‘অনেক সময় লোকোবল কম পড়ে, তখন ডিউটি করতে সমস্যা। আমার দুই ছেলে। পরিবারের সবকাজ সামলে তারপর আমরা অফিসের কাজে যাই। আরএনবি ষোলশহর স্টেশনে আছে, কিন্তু আমাদের এখানে নেই।’
ফতেয়াবাদ জংশন স্টেশনের সহকারী মাস্টার (গ্রেড-৪) আসমা আক্তার বলেন, ‘আমাদের রোস্টার ডিউটি। পরিবার সামলে আমাদের চাকরি করতে হয়। মানসিক প্রেসারটা আমাদের বেশি থাকে। জংশন ও টার্মিনাল স্টেশনে তো আরএনবি থাকে, কিন্তু অন্যান্য স্টেশনে তেমন নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকে না। তবে আমার এখানে আমি এখনও অনিরাপদ বোধ করিনি।’
তিনি বলেন, ‘আমার অপ্রাপ্তি বলতে, আমি সম্প্রতি প্রমোশন থেকে বঞ্চিত হয়েছি। কার প্রতিহিংসার শিকার হলাম জানি না।’
নারীদের দায়িত্ব পালন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা (পূর্ব) আনিসুর রহমান বলেন, ‘আমাদের যথেষ্ট সমস্যা আছে। তবে নারীদের মধ্যে প্রায়ই ব্রাঞ্চ লাইনে আছেন। ব্রাঞ্চ লাইনে সুবিধা হচ্ছে, এসব লাইনে ট্রেন চলে না। নারীদের জন্য মাতৃত্বকালীন সুবিধা থেকে শুরু করে যা আছে, আমরা তা গুরুত্বের সঙ্গে দেখি।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ রেলের সামগ্রিক বিষয় হচ্ছে নিরাপত্তা। আমাদের বিভিন্ন স্টেশনে আরএনবি আছে, পটিয়ায় আছে। আমাদের নারী গার্ডও আছে। তাদের পেশাও চ্যালেঞ্জিং। তবে এখনও পর্যন্ত কোনো নারীর কাছ থেকে অভিযোগ পাইনি।’
ডিজে