১৪ বছর পর আইয়ুব বাচ্চুর দুই গান খুঁজে পেল ঠিকানা

আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া গান ‘ভাবসূত্র’ ২০০৫ সালে রেকর্ড করা হয়েছিল অ্যালবামে প্রকাশের জন্য। তবে সেটা তখন প্রকাশিত হয়নি। শুক্রবার (১৬ আগস্ট) এই কিংবদন্তির মৃত্যুর পর প্রথম জন্মদিনে বিকালে সেই গান প্রকাশ করলো প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সাউন্ডটেক।

কিছুটা লুকোচুরি, কিছুটা অভিমান/ কিছুটা থাকে অভিনয়/ কিছুটা কাছে পাওয়া/ কিছুটা দূরে হাওয়া/ কিছুটা হারাবার ভয়/ এই সব নিয়েই তো মানুষে মানুষে চিরকালই ভাব হয়…’ এমন কথা দিয়ে শুরু হয় ‘ভাবসূত্র’ গানটি।

‘ভাবসূত্র’-এর কথা লিখেছেন গীতিকবি মারজুক রাসেল। সুর ও সংগীতায়োজন করেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু নিজেই। তবে নতুন করে এই গানের রি-মাস্টারিং করেছেন আনিসুজ্জামান আনিস। সেই সাথে “ফিসফাসফিস” শিরোনামে আইয়ুব বাচ্চুর আরেকটি গান একইভাবে ২০০৫ সালে প্রকাশের কথা থাকলেও বিশেষ কারণে তাও হয়ে ওঠেনি। তবে এই অপ্রকাশিত গান দুটি দর্শকদের জন্য কিংবদন্তি এই শিল্পীর জন্মদিনে প্রকাশ হল গীতিকার মারজুক রাসেলের উদ্যোগে।

প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সাউন্ডটেকের কর্ণধার সুলতান মাহমুদ বাবুল চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এই গানটি অনেক আগে তৈরি করা। সেদিন হঠাৎ মারজুক রাসেল আমাকে বিষয়টি মনে করিয়ে দেন। খোঁজাখুঁজি করে বের করে নতুনভাবে মাস্টারিংও করেছি। তবে ফুটেজ স্বল্পতার কারণে ভিডিও তৈরি করা সম্ভব হয়নি। তাই লিরিক্যাল ভিডিও হিসেবে এটি এসেছে।

এদিকে গানটি প্রকাশ করে ইউটিউবের ফুটনোটে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিস্তারিত জানালেন গীতিকবি মারজুক রাসেল। তিনি সেখানে যেমনটা লিখেছেন তার হুবহু তুলে ধরা হলো—

শুভজন্মদিন বাচ্চু ভাই[ Ayub Bachchu]―
আজ প্রকাশিত হইল ‘ভাবসূত্র’―
আনরিলিজডকথা―
২০০৪-এ ‘ফিসফাসফিস’ টাইটেলের একটা অ্যালবাম আয়োজন করছিলাম। লেবেল : সাউন্ডটেক। কণ্ঠশিল্পী: আইয়ুব বাচ্চু,আসিফ[ Asif Akbar] ও পান্থ কানাই। গানের কথা আমার। সুর-সঙ্গীত বাচ্চু ভাই[আইয়ুব বাচ্চু] ও টিটোর[ Niaz Mahmud Chowdhury Tito]। দীর্ঘদিন ধরে প্রত্যেকের ৪টা―মোট ১২টা গান [ বাচ্চু ভাইর ৪টা এবি কিচেনে, আসিফ ও পান্থ কানাইর ৮টা সাউন্ড গার্ডেন স্টুডিয়োয়] রেকর্ড করে ২০০৫-এর ১০ জানুয়ারি অ্যালবামটা টেকনিক্যাল কোনো কারণে ১১টা গান নিয়ে রিলিজ হয়। ১টা গান থেকে যায়; ‘ভাবসূত্র’ টাইটেলের আনরিলিজড ওই গানটার সুর-সঙ্গীত-কণ্ঠ বাচ্চু ভাইর।… রিলিজের পর দিন-মাস-বছর যায়,আনরিলিজ গানটার কথা সংশ্লিষ্ট সবাই ভুলে যাই।…কবিতা-গানের চেয়ে ভিজুয়াল মিডিয়ামে বেশি জড়ায়া যাওয়ার ভিতরেও মাঝে-মাঝে গানটার কথা মনে পড়তো,আবার ভুইলাও যাইতাম;আবার মনে পড়ত,ভুইলা যাইতাম।…এইরকম ‘ভোলা’-‘মনে পড়া’ চলতে-চলতেই বাচ্চু ভাই যেদিন প্রয়াত হলেন,সেদিন[১৮ অক্টোবর,২০১৮] থেকে তাঁর সঙ্গে গান নিয়ে কাটানো অম্লমধুর অনেক স্মৃতি,মন-খারাপ ও ‘ভাবসূত্র’ গানটার কথা যতক্ষন সজাগ থাকতাম ততক্ষণ মনে হইতে থাকলো। সাউন্ডটেকের বাবুল ভাইর[ Sultan Mahmood Babul ] সাথে যোগাযোগ করে আনরিলিজ গানটার কথা জানালাম। উনি কয়েকদিন টাইম নিয়ে প্রায় ১৪ বছর আগের DAT [Digital Audio Tape] খুঁজে বের করে জানালেন। আমার খোঁজে DAT-Player আছে কি না,জানতে চাইলেন।… DAT-Player আছে,চেনাজানা এমন একটা জায়গায় DAT পাঠানোর পর সেখানে ১০/১২ দিনেও কোনো কাজ হইলো না। এর মধ্যে একবার এলারবির মাসুদের কাছে ওই সময়ের প্রসঙ্গ এনে গানটার কথা বললাম;তিনি বললেন,স্টুডিও লকড,খুললে জানানো যাবে হয়তো!…যাইহোক,শেষে বন্ধু দূরে[ গায়ক,রেকর্ডিস্ট] খোঁজ দিল আনিস ভাই’র[ প্রমিথিউসের Anisuzzaman Anis]। ফাঙ্গাসটাঙ্গাস পড়ে প্রায়-বাতিল হয়ে যাওয়া DAT-টা টেকনিক্যাল ও তাঁর উদ্ভাবিত নানান পদ্ধতিতে ফাঙ্গাসমুক্ত করে গানটার এডিট ও রিমাস্টার করে দিলেন আনিস ভাই। আনিস ভাইকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ সুলতান মাহমুদ বাবুল ভাই ও সাউন্ডটেক কর্তৃপক্ষকে।
বাচ্চু ভাইর অনুপস্থিতিতে গানটা শ্রোতাদের কাছে যাচ্ছে জেনে একাধারে মন-খারাপ ও ভালো লাগা―দুইটাই হচ্ছে।
‘the axe forgets,
but the tree remembers.’
—African proverb

এদিকে ইউটিউবে প্রকাশের পর গানটি দুটি বেশ সাড়া ফেলেছে শ্রোতাদের মাঝে।

আইয়ুব বাচ্চু, আসিফ ও পান্থ কানাইয়ের মিশ্র অ্যালবাম ‘ফিসফাসফিস’-এর জন্যই গানটি রেকর্ড করা হয়েছিল ‘ভাব সূত্র’ গানটি৤ ব্যান্ডদল এলআরবির দলনেতা আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন একাধারে গায়ক, গিটারিস্ট, গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ১৮ অক্টোবর এলআরবি’র প্রধান ব্যান্ড তারকা আইয়ুব বাচ্চু পৃথিবীর মায়া ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যান। দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যান্ড এলআরবি’র দলনেতা আইয়ুব বাচ্চু রূপালি গিটারের জাদুকর হিসেবে আলাদা সুনাম ছিল। পাশাপাশি ভক্তদের কাছে তিনি ‘এবি’ নামেও পরিচিত।

রূপালি গিটারের জাদুকর আইয়ুব বাচ্চু

১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আইয়ুব বাচ্চু। ১৯৭৮ সালে ফিলিংস ব্যান্ডের মাধ্যমে সংগীত জগতে তার পথচলা শুরু হয়। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সোলস ব্যান্ডে লিড গিটারিস্ট হিসেবে যুক্ত ছিলেন তিনি। এরপর ১৯৯১ সালে তিনি এলআরবি ব্যান্ড গঠন করেন। প্রথম অ্যালবাম ‘এলআরবি’ প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। এটাই দেশের প্রথম ডাবল অ্যালবাম। এলআরবিরর অন্য অ্যালবামগুলো হলো ‘সুখ’ (১৯৯৩), ‘তবুও’ (১৯৯৪), ‘ঘুমন্ত শহরে’ (১৯৯৫), ‘ফেরারি মন’ (১৯৯৬), ‘আমাদের’ (১৯৯৮), ‘বিস্ময়’ (১৯৯৮), ‘মন চাইলে মন পাবে’ (২০০১), ‘অচেনা জীবন’ (২০০৩), ‘মনে আছে নাকি নাই’ (২০০৫), ‘স্পর্শ’ (২০০৮), ‘যুদ্ধ’ (২০১২) ও ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’ (২০১৬)।

১৯৮৬ সালে প্রকাশিত ‘রক্তগোলাপ’ তার প্রথম প্রকাশিত একক অ্যালবাম। তার সাফল্যের শুরুটা হয় দ্বিতীয় একক অ্যালবাম ‘ময়না’র (১৯৮৮) মাধ্যমে। ১৯৯৫ সালে বাজারে আসে তার তৃতীয় একক অ্যালবাম ‘কষ্ট’। এর প্রায় সব গানই জনপ্রিয়তা পায়। বিশেষ করে ‘কষ্ট কাকে বলে’, ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘অবাক হৃদয়’, ‘আমিও মানুষ’ গানগুলো। তার অন্য একক অ্যালবামগুলো হলো ‘সময়’ (১৯৯৮), ‘একা’ (১৯৯৯), ‘প্রেম তুমি কি’ (২০০২), ‘দুটি মন’ (২০০২), ‘কাফেলা’ (২০০২), ‘রিমঝিম বৃষ্টি’ (২০০৮), ‘বলিনি কখনো’ (২০০৯), ‘
জীবনের গল্প’ (২০১৫)।

আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া গানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘চলো বদলে যাই’। এর কথা ও সুর তারই। শ্রোতাপ্রিয় গানের তালিকায় আরও রয়েছে ‘শেষ চিঠি কেমন এমন চিঠি’, ‘ঘুম ভাঙা শহরে’, ‘হকার’, ‘সুখ’, ‘রুপালি গিটার’, ‘গতকাল রাতে’, ‘তারা ভরা রাতে’, ‘এখন অনেক রাত’ ইত্যাদি।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!