১১ দিনেও চট্টগ্রামের খালে ভেসে যাওয়া লোকটির খোঁজ নেই, গা-ছাড়া সবাই
সিটি কর্পোরেশন-সিডিএ কেউই দায় নিতে চায় না
চট্টগ্রাম নগরীর মুরাদপুরে রাস্তার পাশের খালে পড়ে নিখোঁজ হওয়া সবজি বিক্রেতা সালেহ আহমদের (৫০) খোঁজ মেলেনি ১১ দিনেও। ১১ দিন ধরে সালেহ আহমদের খোঁজে উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রেখেছে ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা। এদিকে বৃষ্টির পানি জমে রাস্তা আর খাল একাকার হয়ে যাওয়ার ফলে একজন পথচারীর এমন পরিণতির পর এতগুলো দিন পার হয়ে গেলেও এই ঘটনায় দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি দায়িত্বশীল কোনো প্রতিষ্ঠানই। ব্যস্ততম সড়কের পাশে ওই খালটি চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতাধীন। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রকল্পটির কাজ চলছে গত কয়েক বছর ধরে।
এর মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী ছাড়া কেউ সালেহ আহমদের পরিবারের খোঁজখবর নেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করেনি। তবে এই ঘটনায় দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর দায় রয়েছে জানিয়ে এর তদন্ত ও সালেহ আহমদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি করছেন অনেকেই।
এমন দাবির প্রেক্ষিতে চসিক মেয়র বলছেন, এক্ষেত্রে তদন্ত করার দায়িত্ব জেলা প্রশাসন অথবা সিডিএর ওপরেই বর্তায়। অন্যদিকে জেলা প্রশাসক বলেছেন, সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ঘটা এই ঘটনায় দায়দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনকেই নিতে হবে। এমনকি তদন্তের প্রয়োজন হলে সেটাও সিটি কর্পোরেশনকে দায়িত্ব নিতে হবে। চসিকের এলাকায় ঘটা এমন দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসনের কিছুই করণীয় নেই— এমন কথা জানিয়েছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক।
তবে এই ঘটনার দায় সিটি কর্পোরেশন এড়াতে পারে না— এমন মন্তব্য করে নাগরিকদের নিরাপত্তা ও অধিকারের প্রশ্নে এই ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলার সম্পাদক এডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী।
গত ২৫ আগস্ট দুপুর ১১টার দিকে মুরাদপুর মোড়ের সাথে লাগোয়া খালে পড়ে মুহূর্তেই তলিয়ে যান সালেহ আহমদ। সে সময় বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতার কারণে মুরাদপুর মোড়ের ওই অংশে খাল ও রাস্তা পানিতে একাকার হয়ে থাকা এবং খালের মুখে কোনরকম সতর্কতা নির্দেশনা অথবা খালের পাশে কোন নিরাপত্তা বেস্টনি না থাকায় শুরু থেকেই এই ঘটনার জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে দায়ী করে আসছেন চট্টগ্রামের নাগরিক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। স্থানীয়দের দাবি, মোড়ের পাশের এই খালগুলোর ওপরে আগে স্ল্যাব ছিল। পরে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজের অংশ হিসেবে সেসব অপসারণ করে খালের মুখ উন্মুক্ত করে দিলেও সেখানে কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করেনি প্রকল্পের দায়িত্বশীলরা।
এদিকে যার দোষেই ঘটনা ঘটুক না কেন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের এলাকায় ঘটা এমন ঘটনার দায় দায়িত্ব চসিককেই নিতে হবে— এই মন্তব্য করে সুজনের চট্টগ্রাম জেলা সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘রাস্তার পাশেই মুখ খোলা খাল অথচ কোন নিরাপত্তা বেস্টনী নাই, কোনো সতর্কতা বার্তা নাই। বৃষ্টি হলে সেখানে রাস্তা আর খাল একাকার হয়ে যায়— এটা তো সবাই জানে। তাহলে রাস্তায় একটা গর্ত হলেও তো মানুষ একটা লাঠি দিয়ে দেয়। যাতে কেউ সেই গর্তে না পড়ে। আর এখানে মূল সড়কের পাশে এত বড় খাল, অথচ কিছুই নেই। তো মানুষ বুঝবে কী করে, সে রাস্তায় পা দিচ্ছে না খালে? এর দায়িত্ব তো সিটি কর্পোরেশনকে নিতেই হবে। এটা তদন্ত হওয়া উচিত এবং কে দায়ী সেটা খুঁজে বের করে তাকে শাস্তির আওতায় আনার পাশাপাশি এই পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’
এদিকে প্রশাসনের নির্বিকারভাব নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে সালেহ আহমদের ছেলে সাদেক উল্লাহ মাহিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘একটা মানুষ এভাবে হারিয়ে গেছে। ১১ দিন ধরে খোঁজ নাই। অথচ প্রশাসনের সে রকম কোনো তৎপরতা নাই।’
দায়িত্বশীল কেউ তাদের পরিবারের খোঁজ খবর নিয়েছেন কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে মাহিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সিটি কর্পোরেশন-সিডিএ কেউ কোন খোঁজখবর রাখছে না। মেয়র এসেছিলেন আমাদের বাসায়। বলেছিলেন উনি আমাদের পাশে দাঁড়াবেন। পরে তিনিও আর কিছু বলেননি, আমরাও আর যাই নাই।’
১১ দিনেও সালেহ আহমদের খোঁজ না পাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘একটা লোক এভাবে হারিয়ে গেছে এটা দুঃখজনক। আমি এটা নিয়ে ডিসির সাথে কথা বলেছি। ফায়ার সার্ভিসের সাথেও কথা বলেছি। তারা লাশ উদ্ধারের জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। এখনও করছে।’
এই ঘটনায় তদন্তের প্রয়োজন আছে বলে মনে করছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, ‘তদন্ত তো সরকারের ব্যাপার। এটা জেলা প্রশাসন করতে পারে, যারা প্রকল্প (জলাবদ্ধতা) বাস্তবায়ন করছেন তারা (সিডিএ) করতে পারে।’
তবে এই বিষয়ে পুরোপুরি ভিন্নমত জানালেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘এইটা (তদন্ত) সিটি কর্পোরেশনকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। সিটি কর্পোরেশনের আওতাভুক্ত এলাকা জেলা প্রশাসনের জুরিসডিকশনের মধ্যে পড়ে না। এছাড়া এই ঘটনা কোনো উপজেলায় ঘটলে আমরা দুর্ঘটনায় মৃত্যুর একটা ক্ষতিপূরণ দিতে পারতাম। সিটি কর্পোরেশন এলাকায় এমন ঘটনার জন্য এসব সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমেই হয়।’
তবে এই ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছেন আকতার কবির। তিনি বলেন, ‘এই ঘটনাটা গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে মানুষ মারা যাবে কিন্তু কিছুই হবে না— এটা নাগরিকদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটা সংকট তৈরি করবে। এর বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রয়োজন।’
এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত সালেহ আহমদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেবেন কিনা— এমন প্রশ্নের উত্তরে মেয়র রেজাউল বলেন, ‘আমারটা আমি বলেছি। আমি ওদের বাসায় গিয়েছি, ওদের সাথে দেখা করেছি। বলেছি ছেলের চাকরির দরকার হলে আমি হেল্প করবো। তারা সাহায্য চাইলেও করবো। কিন্তু ওদের তো আসতে হবে।’
সিপি