১০ মাসেও চট্টগ্রামের ১৭ মাদ্রাসাসহ হেফাজত নেতাদের ‘দুর্নীতি’ প্রমাণ করতে পারছে না দুদক

চট্টগ্রামের ১৭টি মাদ্রাসা ও এতিমখানার ব্যাংক হিসাব থেকে কোটি কোটি টাকা ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করেছেন কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের অন্তত ৫০ জন নেতা— দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ঘটা করে এমন অভিযোগ তুলে অনুসন্ধানের কথা বললেও গত ১০ মাসে এ ধরনের কোনো অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। গত বছরের এপ্রিলে হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ ৫০ নেতা ও তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু হয়। এরপর গত ১০ মাসে অভিযোগের প্রমাণ না পাওয়ায় কারও বিরুদ্ধেই অভিযোগ নথিভুক্ত করা হয়নি।

গত বছরের শুরুতে দুদক জানিয়েছিল, হেফাজতের ওই নেতাদের অনেকের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থপাচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ঢাকার দুটিসহ চট্টগ্রামের ১৭টি মাদ্রাসা ও এতিমখানায় অনিয়মের তথ্য পেয়েছে। এসব মাদ্রাসা ও এতিমখানার কোনো কোনোটির বার্ষিক আয় ১২-১৩ কোটি টাকা পর্যন্ত পাওয়া গেছে জানিয়ে দুদক দাবি করেছিল, এসব টাকার বেশিরভাগই মাদ্রাসা-এতিমখানার ব্যাংক হিসাব থেকে হেফাজতে ইসলামের বিভিন্ন পর্যায়ের অন্তত ৫০ নেতার ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে। হেফাজতে ইসলামের এই ৫০ জন নেতার মধ্যে রয়েছে সংগঠনটির সদ্যপ্রয়াত আমির জুনায়েদ বাবুনগরীর নামও।

কিন্তু ১০ মাস পরও দুদক কী ধরনের প্রমাণ পেয়েছে বা আদৌ পেয়েছে কিনা সেটা স্পষ্ট নয়। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, অনুসন্ধানের নামে দুদক শুরু থেকেই সময়ক্ষেপণ করে গেছে। ফলে হেফাজতে ইসলাম নেতাদের বিরুদ্ধে ওঠা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ১০ মাসেও প্রমাণ করতে পারেনি সংস্থাটি।

গত বছরের এপ্রিলে শুরু হওয়া ‘অনুসন্ধানের’ ৯ মাস পরও গত ডিসেম্বরে দুদক সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার এটুকুই জানালেন— ‘ইতিমধ্যে হেফাজতে ইসলামের অভিযুক্ত ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের আয়কর নথি, সরকারি অনুদান, অডিট প্রতিবেদন ও ব্যক্তিগত নথি পাওয়া গেছে। এসব তথ্য যাচাই করা হচ্ছে। ১৯টি মাদ্রাসার মধ্যে ১৭টি মাদ্রাসা থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত ওইসব তথ্য সংগ্রহ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে মাওলানা মামনুল হকসহ বেশ কয়েকজনের তথ্য পাওয়া গেছে। মামুনুল হক, মাওলানা মাহফুজুল হক, মাওলানা আতাউল্লাহ আমিনী, মাওলানা জালাল উদ্দিন আহম্মেদ ও মোহাম্মদ মহসিন ভূঁইয়ার আয়কর নথিসহ অন্যান্য তথ্য পর্যালোচনা করা হচ্ছে।’

দুদক পরিচালক আকতার হোসেন আজাদের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি টিম হেফাজতে ইসলাম নেতাদের ‘অর্থপাচারের’ বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করছে।

দুদকের দাবি অনুযায়ী, দেশ-বিদেশ থেকে কোটি কোটি টাকার চাঁদা পাওয়া ১৯ মাদ্রাসা ও এতিমখানার ১৭টিই চট্টগ্রামের, বাকি দুটি ঢাকার।

দুদকের ‘নজরদারি’তে থাকা চট্টগ্রামের মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলো হল— হাটহাজারীর আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম বড় মাদ্রাসা, জামিয়া ইসলামিয়া হামিউস সুন্নাহ মাদ্রাসা, জামিয়া ইসলামিয়া কাসেমুল উলুম মাদ্রাসা, জামিয়া হামিদিয়া নাছেরুল ইসলাম মাদ্রাসা, মাদ্রাসা মাহমুদিয়া মদিনাতুল উলুম মাদ্রাসা।

রয়েছে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির বাবুনগর আজিজুল উলুম মাদ্রাসা, আল জামিয়াতুল কোরআনিয়া তালিমুদ্দীন হেফজখানা ও এতিমখানা, ফটিকছড়ি পৌরসভা এলাকার নাজিরহাট আল জামেয়াতুল আরাবিয়া নাছিরুল ইসলাম মাদ্রাসা, ফটিকছড়ির জাফতনগর হাফেজুল উলুম মাদ্রাসা ও এতিমখানা, উত্তর নিশ্চিতপুরের আজম তালুকদার বাড়ির তালিমুল কোরআন বালক-বালিকা মাদ্রাসা ও এতিমখানা, সামিনগর ২নং দাতমারা ইউনিয়ন পরিষদের ভুজপুরের উত্তর বারমাসিয়া হাফেজুল উলুম ইসলামিয়া মাদ্রাসা, ভুজপুরের দাতমারা তালিমুল কোরআন ইসলামিয়া মাদ্রাসা, দাতমারা ছোট বেতুয়া এলাকার সিরাজুল উলুম মাদ্রাসা, ভুজপুরের কাজীর হাট এলাকার আল জামিয়া ইসলামিয়া এমদাদুল ইসলাম মাদ্রাসা, পশ্চিম ভুজপুরের আল মাহমুদ ইসলামিয়া বালক-বালিকা মাদ্রাসা ও পশ্চিম আধার এলাকার আল মাদ্রাসাতুল ইসলামিয়া আ-আরাবিয়া হেফজখানা ও এতিমখানা বালক-বালিকা মাদ্রাসা।

এছাড়া ঢাকার দুটি মাদ্রাসা হল— ঢাকার মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা এবং সাত মসজিদ রোডের জামি’আ রহমানিয়া আরাবিয়া কওমি মাদ্রাসা।

অন্যদিকে যেসব হেফাজত নেতার আয়কর নথিসহ অন্যান্য তথ্য পর্যালোচনা করা হচ্ছে বলে দুদক দাবি করছে, সেই নেতাদের মধ্যে আরও রয়েছেন— খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা ইসমাইল নুরপূরী, সাবেক যুগ্ম মহাসচিব ও খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, পীর চরমোনাই ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির এবং বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সহ-সভাপতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম, ইসলামী অন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করিম, ইসলামী অন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ, কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ শিক্ষা বোর্ড আল হাইআতুল উলিয়ার চেয়ারম্যান ও বেফাকুল মাদরিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সভাপতি মাওলানা মাহমুদুল হাসান, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের বিলুপ্ত কমিটির সহ-সভাপতি এবং বেফাকুল মাদরিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের মহাপরিচালক মুহাম্মদ মাহফুজুল হক, বাংলাদেশ ইমাম ও মুসল্লি ঐক্য পরিষদ ডেমরার সদস্য সচিব মাওলানা মাহমুদুল হাসান সিরাজী, বাংলাদেশ ইমাম ও মুসল্লি ঐক্য পরিষদ (কদমতলী) নেতা মাওলানা আব্দুল আলিম সাইফি, বাংলাদেশ ইমাম ও মুসল্লি ঐক্য পরিষদ শ্যামপুরের মাওলানা আব্দুল হক, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের অর্থ সম্পাদক (বিলুপ্ত কমিটির) মুনির হোসাইন কাসেমী।

এই তালিকায় আরও রয়েছেন— ব্রাহ্মণবাড়িয়া দারুল আকরাম মাদ্রাসার পরিচালক আল্লামা সাজিদুর রহমান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ বেড়াতলা মাদ্রাসার পরিচালক হাফেজ জোবায়ের আহাম্মদ আনসারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উচালিয়া মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা জহিরুল ইসলাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুহিলপুর দারমা মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা মেরাজুল ইক কাশেমী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাটাই দক্ষিণ বিরাসা মাদ্রাসার পরিচারক আবু তাহের, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুসিয়া মাদ্রাসার ছাত্র/সভাপতি জিয়া উদ্দিন জিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুসিয়া মাদ্রাসার পরিচালক মুফতি মোবারক উল্লাহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ইসলামপুর মাদ্রাসার পরিচালক বোরহান উদ্দিন কাশেমী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জামিয়া ইউনুসিয়া মাদ্রাসার শিক্ষা সচিব আল্লামা আশেক এলাহী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া কাজীপাড়া সৈয়দুন্নেছা মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা হাফেজ ইদ্রিস এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া অষ্টগ্রাম বাজার মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা বোরহান উদ্দিন।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!