হেফাজতের ‘টাকার ধান্ধা’, চট্টগ্রামের ১৭ মাদ্রাসা দুদকের নজরে

কোনো কোনো মাদ্রাসার বার্ষিক আয় ১২-১৩ কোটিও

চট্টগ্রামের ১৭টি মাদ্রাসা ও এতিমখানার ব্যাংক হিসাব থেকে কোটি কোটি টাকা ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করেছেন কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের অন্তত ৫০ জন নেতা। এই নেতাদের অনেকের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থপাচারের প্রমাণও পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত এপ্রিল থেকে সংস্থাটির এ বিষয়ক অনুসন্ধান চলছে।

দুর্নীতি দমন কমিশন ঢাকার দুটিসহ চট্টগ্রামের ১৭টি মাদ্রাসা ও এতিমখানায় অনিয়মের তথ্য পেয়েছে। এসব মাদ্রাসা ও এতিমখানার কোনো কোনোটির বার্ষিক আয় ১২-১৩ কোটি টাকা পর্যন্ত পাওয়া গেছে। দুদকের অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিপুল পরিমাণ এই টাকা এসেছে দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে। আর এসব টাকার বেশিরভাগই মাদ্রাসা-এতিমখানার ব্যাংক হিসাব থেকে হেফাজতে ইসলামের বিভিন্ন পর্যায়ের অন্তত ৫০ নেতার ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করার প্রমাণও ইতিমধ্যে পেয়েছে দুদক। হেফাজতে ইসলামের এই ৫০ জন নেতার মধ্যে রয়েছে সংগঠনটির সদ্যপ্রয়াত আমির জুনায়েদ বাবুনগরীর নামও।

দুদক পরিচালক আকতার হোসেন আজাদের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের বিশেষ টিম হেফাজতে ইসলাম নেতাদের অর্থপাচারের বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করছে।

দুদকের অনুসন্ধানে দেশ-বিদেশ থেকে কোটি কোটি টাকার চাঁদা পাওয়া ১৯ মাদ্রাসা ও এতিমখানার নাম জানা গেছে। এর মধ্যে ১৭টিই চট্টগ্রামের, বাকি দুটি ঢাকার।

নজরদারিতে থাকা চট্টগ্রামের মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলো হল— হাটহাজারীর আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম বড় মাদ্রাসা, জামিয়া ইসলামিয়া হামিউস সুন্নাহ মাদ্রাসা, জামিয়া ইসলামিয়া কাসেমুল উলুম মাদ্রাসা, জামিয়া হামিদিয়া নাছেরুল ইসলাম মাদ্রাসা, মাদ্রাসা মাহমুদিয়া মদিনাতুল উলুম মাদ্রাসা।

রয়েছে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির বাবুনগর আজিজুল উলুম মাদ্রাসা, আল জামিয়াতুল কোরআনিয়া তালিমুদ্দীন হেফজখানা ও এতিমখানা, ফটিকছড়ি পৌরসভা এলাকার নাজিরহাট আল জামেয়াতুল আরাবিয়া নাছিরুল ইসলাম মাদ্রাসা, ফটিকছড়ির জাফতনগর হাফেজুল উলুম মাদ্রাসা ও এতিমখানা, উত্তর নিশ্চিতপুরের আজম তালুকদার বাড়ির তালিমুল কোরআন বালক-বালিকা মাদ্রাসা ও এতিমখানা, সামিনগর ২নং দাতমারা ইউনিয়ন পরিষদের ভুজপুরের উত্তর বারমাসিয়া হাফেজুল উলুম ইসলামিয়া মাদ্রাসা, ভুজপুরের দাতমারা তালিমুল কোরআন ইসলামিয়া মাদ্রাসা, দাতমারা ছোট বেতুয়া এলাকার সিরাজুল উলুম মাদ্রাসা, ভুজপুরের কাজীর হাট এলাকার আল জামিয়া ইসলামিয়া এমদাদুল ইসলাম মাদ্রাসা, পশ্চিম ভুজপুরের আল মাহমুদ ইসলামিয়া বালক-বালিকা মাদ্রাসা ও পশ্চিম আধার এলাকার আল মাদ্রাসাতুল ইসলামিয়া আ-আরাবিয়া হেফজখানা ও এতিমখানা বালক-বালিকা মাদ্রাসা।

এছাড়া ঢাকার দুটি মাদ্রাসা হল— ঢাকার মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা এবং সাত মসজিদ রোডের জামি’আ রহমানিয়া আরাবিয়া কওমি মাদ্রাসা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, হেফাজতে ইসলাম নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসাগুলোতে দেশের বাইরে ও ভেতর থেকে যেসব অনুদান এসেছে তার পরিমাণ এবং কোথায় কিভাবে এসব অর্থ ব্যয় হয়েছে তার হিসাব নেই। অনুদানের অর্থ মাদ্রাসার ব্যাংক হিসাবে জমা হওয়ার কথা থাকলেও বহু মাদ্রাসার ব্যাংক হিসাবই খোলা হয়নি। এর ফলে অনুদানের অর্থ জমা হয় হেফাজত নেতাদের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে।

অন্যদিকে যেসব হেফাজত নেতার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে তাদের মধ্যে আরও রয়েছেন— খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা ইসমাইল নুরপূরী, সাবেক যুগ্ম মহাসচিব ও খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, পীর চরমোনাই ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির এবং বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সহ-সভাপতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম, ইসলামী অন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করিম, ইসলামী অন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ, কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ শিক্ষা বোর্ড আল হাইআতুল উলিয়ার চেয়ারম্যান ও বেফাকুল মাদরিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সভাপতি মাওলানা মাহমুদুল হাসান, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের বিলুপ্ত কমিটির সহ-সভাপতি এবং বেফাকুল মাদরিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের মহাপরিচালক মুহাম্মদ মাহফুজুল হক, বাংলাদেশ ইমাম ও মুসল্লি ঐক্য পরিষদ ডেমরার সদস্য সচিব মাওলানা মাহমুদুল হাসান সিরাজী, বাংলাদেশ ইমাম ও মুসল্লি ঐক্য পরিষদ (কদমতলী) নেতা মাওলানা আব্দুল আলিম সাইফি, বাংলাদেশ ইমাম ও মুসল্লি ঐক্য পরিষদ শ্যামপুরের মাওলানা আব্দুল হক, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের অর্থ সম্পাদক (বিলুপ্ত কমিটির) মুনির হোসাইন কাসেমী।

এই তালিকায় আরও রয়েছেন— ব্রাহ্মণবাড়িয়া দারুল আকরাম মাদ্রাসার পরিচালক আল্লামা সাজিদুর রহমান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ বেড়াতলা মাদ্রাসার পরিচালক হাফেজ জোবায়ের আহাম্মদ আনসারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উচালিয়া মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা জহিরুল ইসলাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুহিলপুর দারমা মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা মেরাজুল ইক কাশেমী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাটাই দক্ষিণ বিরাসা মাদ্রাসার পরিচারক আবু তাহের, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুসিয়া মাদ্রাসার ছাত্র/সভাপতি জিয়া উদ্দিন জিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুসিয়া মাদ্রাসার পরিচালক মুফতি মোবারক উল্লাহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ইসলামপুর মাদ্রাসার পরিচালক বোরহান উদ্দিন কাশেমী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জামিয়া ইউনুসিয়া মাদ্রাসার শিক্ষা সচিব আল্লামা আশেক এলাহী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া কাজীপাড়া সৈয়দুন্নেছা মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা হাফেজ ইদ্রিস এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া অষ্টগ্রাম বাজার মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা বোরহান উদ্দিন।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!