হাইকোর্টে হাজির হালিশহরে ‘নিহত’ দিলীপ, কিশোরের মুখে পুলিশের সাজানো গল্প

জবানবন্দির ঘটনা খতিয়ে দেখবেন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট

চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহরে ‘পুড়িয়ে মারা’ এক ব্যক্তির জীবিত ফিরে আসার ঘটনায় অবাক হয়ে হাইকোর্ট তলব করেছিলেন ওই হত্যামামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও ‘আগুনে পুড়িয়ে হত্যার শিকার’ সেই দিলীপকে। ‘হত্যার দায়’ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেওয়া দুই কথিত আসামিকে হাজির করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

সে অনুযায়ী বৃহস্পতিবার (২২ অক্টোবর) বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের নির্দেশে কথিত ‘দিলীপ হত্যা মামলা’র দিলীপ আচার্য নিজে, মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা সাইফুল্লাহ, বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম এবং ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া আসামি জীবন চক্রবর্তী (১৮) ও আসামি দুর্জয় আচার্য (১৮) হাজির হন।

হাইকোর্টে ‘মৃত’ দিলীপ আচার্য নিজেই হাজির হওয়ার পর আদালত প্রশ্ন তোলেন, ‘তাহলে ১৬৪ ধারার জবানবন্দি কিভাবে এলো?’ এর উত্তরে আসামি জীবন চক্রবর্তী জানান, চার দিন ধরে টানা নির্যাতন আর রীতিমতো ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে পুলিশের শেখানো গল্পই তিনি আদালতে জবানবন্দি হিসেবে দিয়েছেন।

এখন থেকে ঠিক দেড় বছর আগের কথা। চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর ফইল্ল্যাতলী বাজার খালপাড় এলাকার একটি বাড়ি থেকে পোড়া মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় হালিশহর থানায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করার পর গ্রেপ্তার হন দুর্জয় আচার্য্য ও জীবন চক্রবর্তী নামের দুই যুবক। ‘হত্যার দায়’ স্বীকার করে এর পাঁচদিন পর চট্টগ্রামের আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে গ্রেপ্তার হওয়া জীবন চক্রবর্তী জানান, পোড়া ওই মরদেহ তাদের সহকর্মী দিলীপের। তাকে ও দুর্জয়কে মারধরের প্রতিশোধ নিতে তারা দিলীপকে হালিশহরের নাথপাড়া এলাকায় হত্যা করে। পরে ফইল্ল্যাতলী খালপাড় এলাকার পরিত্যক্ত ওই বাড়িতে মরদেহ নিয়ে যায়। সেখানে মরদেহটি পুড়িয়ে ফেলে।

সব ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু গত বছরের ২১ এপ্রিল স্বীকারোক্তিমূলক এই জবানবন্দি দেওয়ার কয়েকদিন পর ‘হত্যার শিকার’ দিলীপকে চট্টগ্রামের একই আদালতে হাজির করান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। সেই মামলা চলতে থাকে ঢিমেতালে। এদিকে চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দি ওই মামলার আরেক আসামি দুর্জয় আচার্য্য হাইকোর্টে জামিন চাইতে গেলে ‘মৃত ব্যক্তির জীবিত ফিরে আসা’র মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনার কথা শুনে আদালতও অবাক হয়ে যান। এরপরই আদালত এই মামলার সঙ্গে জড়িত সবাইকে তলব করেন।

বৃহস্পতিবার (২২ অক্টোবর) হাইকোর্ট বেঞ্চ সবার বক্তব্য শোনেন। আসামি জীবন চক্রবর্তীকে মারধর করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায়ের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশ দেন। পরে আরেক আসামি দুর্জয় আচার্যকে জামিন দেন।

মামলার শুনানির সময় হালিশহরে ‘পুড়িয়ে মারা’ দিলীপ আচার্যসহ অন্যরা এজলাসে দাঁড়ানো ছিলেন। এ সময় আদালত তাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি কোথায় ছিলেন?’
জবাবে দিলীপ বলেন, ‘আমার স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়। এ কারণে মামলার ভয়ে কিছুদিন বোনের বাড়িতে ছিলাম।’

দুর্জয় আচার্য ও জীবন চক্রবর্তীকে দেখিয়ে আদালত বলেন, ‘আপনি এই দুই আসামিকে চিনেন?’
জবাবে দিলীপ বলেন, ‘আমি তাদের চিনি। দুজনে আমার সঙ্গে চট্টগ্রাম স্টিল মিল এলাকায় একটি রডের কারখানায় চাকরি করেন।’

আদালত ‘আসামি’ দুর্জয় আচার্যের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনার বিরুদ্ধে কেন হত্যার মামলা হল?’
উত্তরে দুর্জয় বলেন, ‘আমি জানি না স্যার। আমি সেদিন দুপুরে বাসার বাইরে খেলছিলাম। পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যায়। চার দিন আটকে রেখে আমাকে নির্যাতন চালায়। ক্রসফায়ার দেওয়ার কথা বলে আমাকে জবানবন্দি দিতে বলে। কিন্তু আমি জবানবন্দি দিইনি।’

এরপর আদালত অন্য আসামি জীবন চক্রবর্তীকে ‘দিলীপ হত্যা মামলা’র বিষয়ে প্রশ্ন করেন। পুলিশের মারধরের ভয়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়ার কথা উল্লেখ করে জীবন চক্রবর্তী এ সময় বলেন, “আমি চট্টগ্রামের স্টিল মিলে একটি রডের কারখানায় কাজ করি। সাপ্তাহিক বন্ধের দিন বাসায় ছিলাম। দুপুরবেলা পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যায়। হালিশহর পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে আমাকে বলে, তোর নামে হত্যার মামলা আছে। চার দিন ধরে আমাকে তদন্ত কর্মকর্তা সাইফুদ্দীন ব্যাপক মারধর করেন। একপর্যায়ে একটি পাথর ও ফুলের টব নিয়ে এসে বলে, ‘তুই আদালতে গিয়ে বলবি, এই পাথর দিয়ে মাথায় আঘাত করে দিলীপকে হত্যা করেছিস।’

এরপর মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা সাইফুদ্দীনকে ডাকেন আদালত। সাইফুদ্দীন আদালতকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায়। লাশটির পুরো শরীর ভস্মীভূত ছিল। এত বেশি পুড়েছে যে, লাশটি কেউ শনাক্ত করতে পারেনি। এছাড়া ওই এলাকায় কোনো ব্যক্তি নিখোঁজ কিনা তাও জানা যায়নি। একপর্যায়ে হালিশহরের দিলীপ নামের এক ব্যক্তি নিখোঁজ হন। তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ওই দিলীপের সঙ্গে কাজ করে জীবন চক্রবর্তী ও দুর্জয় আচার্য। আমি তাদের গ্রেপ্তার করি। জিজ্ঞাসাবাদে তারা দিলীপকে হত্যার কথা স্বীকার করে। এছাড়া লাশের ফরেনসিক রিপোর্টে মাথার খুলিতে আঘাতের কারণে মৃত্যু হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। জীবন চক্রবর্তীর জবানবন্দি ও ফরেনসিক রিপোর্টের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হয়।’

এ সময় আদালত বলেন, ‘আপনারা তদন্ত করলেন কিন্তু দিলীপ তো ফিরে এলো। তাহলে নিহত ব্যক্তিটি কে? এখন ১৬৪ ধারার জবানবন্দির কী হবে?’

এ সময় মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা হালিশহর থানার এসআই কামরুল ইসলাম বলেন, ‘মামলাটি তদন্তের স্বার্থে দিলীপ সম্পর্কে জানার জন্য তার পরিবারকে খুঁজতে থাকি। জানতে পারি, এ দুই আসামির সঙ্গে দিলীপ কাজ করতেন। দিলীপের স্ত্রী নেই, তালাক দিয়েছেন। তখন দিলীপের স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি দিলীপের অবস্থান না জানলেও দিলীপ বোনের বাড়ি খাগড়াছড়িতে বলে জানান। তখন আমরা সেখানে যোগাযোগ করি। বোন জানান, দিলীপ জীবিত আছেন এবং কিছুদিন আগে তাদের এখানে গিয়েছিলেন। পরে মোবাইল ট্র্যাকিং করে দিলীপের অবস্থান চিহ্নিত করা হয় এবং তাকে আদালতে হাজির করা হয়।’

দিলীপ নিজেও আদালতে তার বোনের বাড়ি যাওয়ার কথা স্বীকার করেন। তালাকের মামলার ভয়ে তিনি পলাতক ছিলেন— এটিও আদালতকে অবহিত করেন।

‘নিহত’ বলে কথিত দিলীপ, ‘খুনে জড়িত’ জীবন ও দুর্জয় তিনজনই চট্টগ্রামের জিপিএইচ ইস্পাতের কারখানা শ্রমিক।

গত বছরের ২৭ এপ্রিল সংবাদমাধ্যমকে সিএমপির ডবলমুরিং জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার আশিকুর রহমান বলেছিলেন, ‘পোড়া মরদেহের পরিচয় পেয়েছি আমরা। দিলীপ নামে ওই কিশোর কুমিরা এলাকায় জিপিএইচ ইস্পাত কারাখানার শ্রমিক। জীবন হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। জীবন জবানবন্দিতে জানিয়েছে দিলীপ হত্যার কিছুদিন আগে জীবন ও দুর্জয়কে গালিগালাজ করে। পরে এর রেশ ধরে তাদেরকে মারধরও করে। মারধরের প্রতিশোধ নিতে দিলীপকে পরিকল্পনা করে হত্যা করে তারা দুইজন।’

ওই পুলিশ কর্মকর্তা আরও জানিয়েছিলেন, ‘১৮ এপ্রিল তারা দিলীপকে নাথপাড়া এলাকায় হত্যা করে। পরে ফইল্ল্যাতলী খালপাড় এলাকার পরিত্যক্ত ওই বাড়িতে মরদেহ নিয়ে যায়। সেখানে মরদেহটি পুড়িয়ে ফেলে। এজন্য পরিকল্পনা অনুযায়ী হালিশহর বড়পোল এলাকা থেকে কেরোসিন কেনেন জীবন ও দুর্জয়।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!