হাইকোর্টকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ৫ কোটি টাকার স্থাপনা ভেঙে চট্টগ্রামে ডিসি অফিসের রহস্যময় রোষ
জায়গা সিটি কর্পোরেশনের, বেআইনি উচ্ছেদে ডিসি অফিস
দেশের সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের লিজ নেওয়া প্রকল্প অবৈধভাবে উচ্ছেদ করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। এতে পাঁচ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতিসহ ১৫২ জন মানুষের রুটিরুজির সংস্থান বন্ধ হয়ে গেছে মুহূর্তেই। হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করার কারণ জানতে চাইলে কয়েকজন গণমাধ্যম কর্মীকে গ্রেপ্তারের হুমকি দেন জেলা প্রশাসনের এক ম্যাজিস্ট্রেট। এ সময় জাতীয় জরুরি সহায়তা সেবা ৯৯৯-এ ফোন করে জানালে তারা জেলা প্রশাসক ও চট্টগ্রাম পুলিশ কমিশনারকে অবহিত করতে বললেও সেখান থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। এদিকে অবৈধ এই ভাঙচুরের প্রতিবাদে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা তাৎক্ষণিক মানববন্ধন করেছেন।
রোববার (১৯ মার্চ) চট্টগ্রাম নগরের কাজির দেউড়ি এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে জেলা প্রশাসন। এতে নেতৃত্ব দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নু-এমং মারমা মং। উচ্ছেদ অভিযান শেষে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা সার্কিট হাউজের সামনে মানববন্ধনে নামেন।
মানববন্ধনে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার নু এমং মারমাকে আদালতের নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেখাতে চাইলে তিনি উল্টো গ্রেফতারের ভয় দেখিয়েছেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশনাকে তোয়াক্কা না করে ব্যবসায়ীদের ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে।’
এ সময় তারা প্রশ্ন তোলেন, ‘একজন ডিসি বা ম্যাজিস্ট্রেট কিভাবে সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ অমান্য করার সাহস পান?’
জানা গেছে, ২০১৮ সালে সংবাদপত্রের মাধ্যমে টেন্ডার আহ্বান করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। কিন্তু কোনো টেন্ডার না পাওয়ায় নভেম্বরে রিটেন্ডার দেয় চসিক। এ সময় যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সিকিউরিটি মানি জমা দিয়ে মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন থেকে কাজীর দেউড়ি এলাকায় সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের আওতায় একটি জায়গা লিজ নেন ফিউশন ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর লায়ন এমএ হোসেন বাদল।
এরই মধ্যে করোনাকালে ব্যবসায়ীদের বিশাল ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে দুই বছর অতিক্রান্ত হয়। করোনাকালের সেই ক্ষতি পুষিয়ে না উঠতেই ব্যবসায়ী ও কর্মচারীদের মুখের ভাত কেড়ে নেয় জেলা প্রশাসনের হঠাৎ এই উচ্ছেদ অভিযান।
জানা গেছে, কয়েকদিন আগে চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার (সিজেকেএস) সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির স্বাক্ষরিত একটি নোটিশে হঠাৎ জানানো হয়, লিজ নেওয়া জায়গায় গড়ে তোলা গার্ডেন রেস্টুরেন্ট ‘বাগান বিলাস’ উচ্ছেদ করা হবে। চলতি বছরের ৩১ মার্চের মধ্যে এই স্থাপনায় থাকা সকল মালামাল সরিয়ে নিতে লিখিতভাবে জানানো হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগেই রোববার (১৯ মার্চ) চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের তত্ত্বাবধানে জেলা প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে সকল স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ী ফিউশন ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর লায়ন এমএ হোসেন বাদল বলেন, ‘পুরো প্রকল্পের ওপর উচ্চ আদালতে রিট করলে মহামান্য হাইকোর্ট গত ১৬ মার্চ ওই স্থানে ইনজাংশন জারি করেন। ইনজাংশনের কাগজাপত্র আমরা রিসিভ করাতে গেলে জেলা প্রশাসন কার্যালয় গ্রহণ করেনি। এরপর উচ্চ আদালতের ইনজাংশনের কাগজাদি জেলা প্রশাসনের ইমেইল ও হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো হয়। কিন্তু এর কোনো সদুত্তর দেননি জেলা প্রশাসক।’
অবৈধ উচ্ছেদ অভিযানের পেছনে জেলা প্রশাসনের উর্ধতন কারও ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের ঘটনা রয়েছে— এমন দাবি করে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, সিজেকেএস ৩১ মার্চ পর্যন্ত মালামাল সরিয়ে উচ্ছেদ করার সময় নির্ধারণ করলেও জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নু-এমং মারমা মং বাগান বিলাসসহ পুরো প্রকল্পে উচ্ছেদ অভিযানের জন্য অস্বাভাবিক পীড়াপিড়ি শুরু করেন। এ সময় জাতীয় জরুরি সহায়তা সেবা ৯৯৯-এ ফোন করে জানালে তারা জেলা প্রশাসক ও চট্টগ্রাম পুলিশ কমিশনারকে অবহিত করতে বলেন। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের নিজস্ব ও সরকারি নম্বরে ফোন করলেও তিনি ফোন কল রিসিভ করেননি। অন্যদিকে পুলিশ কমিশনারের ক্ষেত্রেও তার ফোনে সাড়া পাওয়া যায়নি।
দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অবহেলার কথা উল্লেখ করে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা বলেন, পরে আবারও ৯৯৯ এ ফোন করা হলে তারা স্থানীয় থানায় যোগাযোগ করতে বলেন। তাদের নির্দেশে নগরের কোতোয়ালী থানার অফিসার ইনচার্জকে ফোন করা হলে, তিনি জেলা প্রশাসকের দ্বারস্থ হতে বলেন। এ বিষয়ে তিনি কোনো ধরনের সহযোগিতা করতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন। এরপর আবারও ৯৯৯ এ ফোন কল করা হলে তারা ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে সাহায্য চাইতে বলেন।
ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ী লায়ন এমএ হোসেন বাদল বলেন, ‘আমি ম্যাজিস্ট্রেটকে সিজেকেএসের সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত চিঠিতে আমাদের আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে স্থাপনা সরিয়ে নিতে বলার বিষয়টি জানাই। একইসঙ্গে আমি এ সংক্রান্ত মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশের বিষয়টি তুলে ধরি এবং ১৬ মার্চে দেওয়া মহামান্য হাইকোর্টের ইনজাংশনের আদেশটি দেখাই। কিন্তু জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নু-এমং মারমা মং বলেন, আমি জেলা প্রশাসক স্যারের নির্দেশে এসেছি। আপনারা উনাকে জানান।’
এ সময় কয়েকজন গণমাধ্যম কর্মী হাইকোর্টের ইনজাংশনের বিষয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জানতে চাইলে তিনি হুমকি দিয়ে বলেন, ‘বেশি কথা বললে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হবে।’
লায়ন বাদল আরও বলেন, ‘এরপর আমি মহামান্য হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার আদেশ নিয়ে ডিসি অফিসে ছুটে যাই। তবে উনি কোনো সদুত্তর দেননি। এর মধ্যেই তড়িঘড়ি করে আমার স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু হয়ে যায়। এ সময় একে একে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় তিল তিল করে গড়ে তোলা স্থাপনা।’
তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের আওতায় রয়েছে প্রতিবন্ধীদের দুটি দোকান ও একটি পাবলিক টয়লেটও। সব মিলিয়ে আমাদের প্রায় ৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। মুহূর্তেই কেড়ে নেওয়া হয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ১৫২ জন কর্মচারীর মুখের ভাত।’
লায়ন বাদল বলেন, ‘গত ডিসেম্বরে চট্টগ্রামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে যোগ দিতে এসে মারা যাওয়া কর্মী জহিরের পরিবারকে বিনামূল্যে একটি নার্সারি করে দিয়েছিলাম, সেটিও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’
পাভেল চৌধুরী নামে এক ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ী বলেন, ‘বেঁচে থাকার স্বপ্নটা ও পরিবারের আয়ের রাস্তাটা এক নিমেষেই বদলে গিয়েছে। আমি পড়াশোনার পাশাপাশি রাজনীতিতে সময় দিয়েছি, সর্বদা মানুষের কল্যাণে নিজের জীবনের পরোয়া না করে কাজ করে গিয়েছি। রাজপথে সংগঠনের কাজে সর্বদা সময় দিয়েছি, অন্যর কাছে কখনো হাত পাতি নাই। নিজের জন্য সর্বদা স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করেছি। তবে, আজ এটার প্রতিফলন পেলাম। কারো বিন্দুমাত্র সাহায্য পেলাম না। আল্লাহ সহায়।’
এদিকে সংবাদ সম্মেলনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা স্বাধীন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ অমান্য করার নেপথ্যের কারণ খতিয়ে দেখার দাবি জানান। একই সঙ্গে বিশাল অংকের আর্থিক ক্ষতি ও ১৫২ জন কর্মচারীর বেকার হয়ে যাওয়ার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানান।