হরিলুট/ চট্টগ্রাম ওয়াসায় যত বড় বেতন নয় তত বড় ওভারটাইম!
এক মাসে তার ওভারটাইমের পরিমাণ ছিল ২০০ ঘন্টা— ৮ ঘন্টার নিয়মিত শিফটের বাইরেও প্রতিদিন তিনি কাজ করতেন আরও সাড়ে ৬ ঘন্টা! এই হিসেবে চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাটে চট্টগ্রাম ওয়াসার বুস্টার স্টেশনে দিনে ১৪ ঘন্টারও বেশি সময় কাজ করছেন প্রতিদিন। গত বছরের জুলাইয়ে এই লোক মাসিক বেতন হিসেবে পান ১৯ হাজার ৮১০ টাকা, ওই একই সময়ে শুধু ওভারটাইম থেকে তার আয় ছিল ৩৮ হাজার ২৫১ টাকা। তিনি আলী আক্কাস, চট্টগ্রাম ওয়াসার একজন ইলেকট্রিশিয়ান। কাগজপত্রে দেখা যায়, এই আক্কাস ২০১৭ সাল থেকে প্রতি মাসে প্রায় ২০০ ঘণ্টা ওভারটাইম থেকে আয় করছেন তার মূল বেতনের প্রায় দ্বিগুণ।
আলী আক্কাস একটি উদাহরণ মাত্র। চট্টগ্রাম ওয়াসায় এরকম আলী আক্কাসের সংখ্যা অগণন। আক্কাসের সহকর্মী মাহাবুবুল আলম মিয়া কিংবা মো. আজমলের কথাই ধরা যাক। এই দুজনও প্রতি মাসে ওভারটাইম বাবদ অস্বাভাবিক পরিমাণে আয় করে যাচ্ছেন। পাম্প অপারেটর হিসাবে কাজ করা এই দুজনের মাসিক মূল বেতন ১৯ হাজার ৮১০ টাকা। প্রতি মাসে তাদের প্রত্যেকেই ওভারটাইম থেকে বাড়তি আয় করছেন ২৭ হাজার ৪৭৪ টাকা।
ওয়াসার মোটর মেকানিক নিজাম উদ্দিন ওভারটাইম থেকে প্রতি মাসে আয় করছেন ২৮ হাজার ২৫১ টাকা।
এভাবে চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাটে চট্টগ্রাম ওয়াসার বুস্টার স্টেশনে কর্মরত ২০ জন কর্মীর মধ্যে ১৭ জনই তাদের বেতনের চেয়ে দ্বিগুণ টাকা ওভারটাইম হিসেবে দেখিয়ে টাকা তুলে নিচ্ছেন বছরের পর বছর।
২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্মীদের বেতনের তালিকা এবং অন্যান্য নথি ঘেঁটে এসব তথ্য জানা গেছে। নথিগুলোতে অন্যান্য অনিয়মের পাশাপাশি ওয়াসা কর্মীদের ভুতুড়ে ওভারটাইমের অনেক ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে।
কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, চলতি বছরের জুলাইয়ে ওয়াসার বহদ্দারহাট বুস্টার স্টেশনে কর্মরত ২০ জন কর্মীকে বেতন দেওয়া হয়েছে মোট তিন লাখ দুই হাজার ৬০০ টাকা। ওই মাসে আবার এই কর্মীদের ওভারটাইম হিসেবে দেওয়া হয়েছে তিন লাখ ৩১ হাজার ১৬৮ টাকা। অন্যদিকে ২০১৮ সালের জুলাইয়ে এই কর্মীদের বেতন বাবদ দুই লাখ ৭৭ হাজার ৩৫০ টাকা এবং ওভারটাইম বাবদ দেওয়া হয়েছে তিন লাখ ২৮ হাজার ২৮৬ টাকা। তার আগের বছর, ২০১৭ সালে ওই ২০ কর্মীকে বেতন দেওয়া হয়েছে দুই লাখ ৬৪ হাজার ৪৮০ টাকা এবং ওভারটাইম পরিশোধ করা হয়েছে তিন লাখ ৪০ হাজার ৭৫৮ টাকা।
এমন অস্বাভাবিক ওভারটাইম কিভাবে সম্ভব— চট্টগ্রাম ওয়াসার ইলেকট্রিশিয়ান আলী আক্কাসকে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি যুক্তি দেখান— ‘শ্রমিকের অভাবের কারণে আমাকে অতিরিক্ত কাজ করতে হয়। এজন্য দীর্ঘ সময় ধরে ওভারটাইম কাজ করতে হচ্ছে।’
যদিও আক্কাসের সুপারভাইজার, চট্টগ্রাম ওয়াসার বহদ্দারহাট বুস্টার স্টেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী সরফরাজ আকতার এই অস্বাভাবিক ওভারটাইমগুলোর অনুমোদন দেন। কিন্তু তিনিও বলছেন, ‘আক্কাস কিভাবে ২০০ ঘন্টা কাজ করেন, সে সম্পর্কে কোনও ধারণা করতে পারছি না।’
সরফরাজ আকতার স্বীকারও করেছেন, ‘কোনো কর্মী প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ১৫২ ঘন্টা পর্যন্ত ওভারটাইম করতে পারে।’
প্রায় একই ধরনের পরিস্থিতি দেখা গেছে চট্টগ্রাম ওয়াসার অন্যান্য স্টেশনেও, যেখানে কর্তৃপক্ষ অস্বাভাবিক ওভারটাইম বিলের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে।
তদন্তে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম ওয়াসার শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার ও মডিউল ১, ২, ও ৩-এ কর্মরত পাম্প অপারেটর, ইলেকট্রিশিয়ান, সহকারী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, ল্যাবরেটরি সহকারীসহ মোট ৪৯ স্থায়ী কর্মচারীর সবাই ওভারটাইমের নাম দিয়ে বড় অঙ্কের টাকা তুলেছেন।
২০১৮ সালের জুলাই মাসে শেখ হাসিনা পানি শোধনাগারের ৩৪ জন কর্মচারী বেতন হিসেবে পেয়েছেন ৪ লাখ ৫২ হাজার ৭৪০ টাকা। একই সময়ে ওভারটাইম হিসেবে পেয়েছেন আরও চার লাখ ৮০ হাজার ২৬১ টাকা। আর চলতি বছরের জুলাই মাসে তাদের ওভারটাইম বাবদ ওয়াসা খরচ করেছে চার লাখ ৯৮ হাজার ৭৭৯ টাকা, এর বাইরে মূল বেতন হিসেবে খরচ হয়েছে আরও ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৫০ টাকা।
নথি থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, শুধু ২০১৯ সালের জুলাই মাসেই চট্টগ্রাম ওয়াসার ২২৯ জন পাম্প অপারেটর এবং ইলেকট্রিশিয়ান ওভারটাইম হিসেবে পেয়েছেন ৩৪ লাখ টাকা।
প্রতি বছর কর্মচারীদের বেতন বাবদ ৪.১৬ কোটি টাকা এবং ওভারটাইম বাবদ তার চেয়েও বেশি ৫.১৯ কোটি টাকা ব্যয় করে চট্টগ্রাম ওয়াসা। এতে বোঝাই যাচ্ছে, পর্যাপ্ত জনবল থাকার পরও কাগজেকলমে অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা বা ওভারটাইম দেখিয়ে অতিরিক্ত টাকা তুলে নিচ্ছে ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
কর্মচারীদের ওভারটাইম অনুমোদনের দায়িত্বে থাকা তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মাকসুদুল আলম আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে বলেছেন, ‘এটি আমার দোষ নয়, কারণ সংশ্লিষ্ট বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীরা রোস্টার প্রস্তুত করে ওভারটাইম বিল অনুমোদন করেন।’
ওভারটাইমের সাফাই গাইতে গিয়ে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী একেএম ফজলুল্লাহ বলেন, ‘পাম্পগুলো চালু রাখার জন্য মাঝে মাঝে ওভারটাইম করাতে হয়। কিন্তু অতিরিক্ত ওভারটাইমের ব্যাপারে আমরা যথেষ্ট সচেতন থাকার চেষ্টা করি। কর্মচারীদের ওভারটাইম কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।’
পরবর্তী পর্বে
বন্ধ পাম্প ‘চালাতে’ ২৪ ঘন্টার ২৯ ঘন্টাই কাজ!
বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের প্রতিবেদন অবলম্বনে