হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা। অর্ধ পৃথিবীর শাসক। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর প্রিয় সাহাবি। তিনি ন্যায়নীতিতে ছিলেন দৃঢ় প্রত্যয়ী। অন্যায়ের প্রতিবাদে ছিলেন অপ্রতিরোধ্য বীরসেনানী। তার নাম শুনলে সে যুগের বড় বড় বীর বাহাদুরের গলা শুকিয়ে যেত ভয়ে। কারণ তিনি ছিলেন যুগখ্যাত অকুতোভয় সিপাহসালার। মরণজয়ী মুজাহিদ। হজরত ওমর ফারুক (রা.) ছিলেন ইসলামি রাষ্ট্রের অন্যতম রূপকার। খলিফা হিসেবে আমিরুল মোমেনিন ছিল তার উপাধি। হজরত ওমর ফারুক (রা.) এমন এক সময়ে ইসলাম গ্রহণ করেন যখন মুসলমানের সংখ্যা ছিল মাত্র ৪০ জন। তখন কেউ ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দিলে অথবা কারো কারো ইসলাম গ্রহণের বিষয়ে জানতে পারলে মক্কার কাফেরেরা তার ওপর নির্যাতন শুরু করে দিতো। মুসলমানরা সেই সময় গোপনে লুকিয়ে লুকিয়ে নামাজ আদায় করতেন। হজরত ওমর ফারুক (রা.) নিজেও প্রথম দিকে ইসলামের আহ্বানের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছিলেন।
ইসলাম গ্রহণ
হজরত ওমর ফারুক (রা.)-সবসময় নির্ভীক ছিলেন। তিনি যা সত্য ও সঠিক মনে করতেন অপকটে তা মেনে নিতেন এবং সবার সামনে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিতেন। আল্লাহতায়ালা তার অন্তরে ইসলামের নূর ঢেলে দেওয়ার পর তিনি মক্কার কাফেরদের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে ঘোষণা দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং বায়তুল্লাহতে গিয়ে সবার সামনে নামাজ আদায় করলেন। মুশরিকরা ইসলাম গ্রহণের কারণে অন্যদের নির্যাতন করলেও তাকে কিছু বলার বা করার সাহস পেত না।
খেলাফতের দায়িত্ব
হজরত ওমর (রা.) ইসলাম গ্রহণ মুসলানদের শক্তিশালী করেছিল। ইসলাম গ্রহণের মতো তার শাসনামলও মুসলিমদের শক্তিশালী করেছিল। তিনি খলিফা নির্বাচত হন হজরত আবু বকর (রা.) ইন্তেকালের পর। তবে হজরত আবু বকর (রা.) বিশৃঙ্খলা এড়াতে নিজের ইন্তেকালের আগেই তাকে পরবর্তী খলীফা মনোনীত করে যান। হজরত আবু বকর (রা.) নিজের অন্তিম সময়ে বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবদুর রহমান ইবন আউফ, উসমান ইবন আফফানসহ আরও বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সাহাবির সঙ্গে আলোচনা করে হজরত ওমর ফারুক (রা.) কে খলিফা নিযুক্ত করে ফরমান জারি করেন। তার সেই ফরমান লিখেছিলেন উসমান ইবনে আফ্ফান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। সেই ফরমানে লেখা হয়েছিল-বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহীম। এটা আবু বকর ইবন আবী কুহাফার পক্ষ থেকে মুসলমানদের প্রতি অঙ্গীকার। আম্মাবাদ আমি তোমাদের জন্য ওমর ইবনুল খাত্তাবকে খলীফা মনোনীত করলাম এবং এ ব্যাপারে তোমাদের কল্যাণ চেষ্টায় কোন ত্রুটি করি নাই। ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ১৩ হিজরি থেকে ২৪ হিজরি মোতাবেক ৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলিফার দায়িত্ব পালন করেন। তার সময়ে সর্বাধিক অঞ্চল মুসলমানদের শাসনের অধীনে এসেছিল। তাকে অর্ধজাহানের খলিফা বলা হতো। আধুনিক শাসনব্যবস্থার রূপকার হজরত উমর (রা.)। হজরত ওমর (রা.)-এর শাসন ব্যবস্থা মুসলিম বিশ্বের জন্য মডেল।
হজরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে মুসলমানরা যেসব দেশ বিজয় করেন
তার শাসনামলে বিজিত ভূখন্ডের আয়তন ছিল সাড়ে বাইশ লক্ষ বর্গমাইল। এ সময় মুসলমানরা যেসব দেশ-প্রদেশ ও অঞ্চল বিজয় করেছিলেন সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-পারস্য, ইরাক, জাজিরাহ, খুরাসান, বেলুস্তিান, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, মিসর, আর্মেনিয়া। তিনি হিজরি ২২ সনে ইসলামী রাষ্ট্রকে বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত করেন। তার বিভিন্ন প্রদেশগুলোর মধ্যে রয়েছে, মক্কা মুকাররামাহ, মদিনা মুনাওয়ারা, সিরিয়া, জাজিরা, বসরা, কুফা, মিসর, ফিলিস্তিন, খুরাসান, আজারবাইন ও পারস্য। এর মধ্যে কোনো কোনো প্রদেশের আয়তন ছিল দুটি প্রদেশের সমান। কোনো কোনো প্রদেশের দুটি কেন্দ্র ছিল এবং প্রত্যেক কেন্দ্রের পৃথক পৃথক কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছিলেন। প্রত্যেক প্রদেশের একজন ওয়ালী বা কর্মকর্তা একজন কাতিব (সচিব) বা মীর মুনশী, একজন সেনানায়ক, একজন সাহিবুল খারাজ বা কালেক্টর, একজন পুলিশ অফিসার, একজন ট্রেজারি অফিসার একজন বিচারক অবশ্যই থাকতেন।
হজরত ওমর (রা.)-এর যুগে ভারতবর্ষে সাহাবায়ে কেরাম
ভারতবর্ষের পবিত্র ভূমিতে ইসলাম ও তাওহিদের চর্চা নবুওয়াতের যুগ থেকেই শুরু হয়েছিল। সর্বপ্রথম সাহাবায়ে কেরামদের বরকতময় পদধূলিতে ভারতবর্ষ ধন্য হয় এবং তাদের মাধ্যমেই এখানে ইসলামের আগমন ঘটে। হজরত ওমর ফারুক (রা.)-এর যুগে ১৫ হিজরিতে রাসুল (সা.)-এর ওফাতের চার বছর পর ভারতবর্ষে সাহাবিদের আগমন শুরু হয়। আমিরুল মুমিনিন হজরত ওমর (রা.)-১৫ হিজরিতে হজরত উসমান বিন আবি আল-আস (রা.)-কে বাহরাইন ও ওমানের গভর্নর নিযুক্ত করেন। হজরত উসমান (রা.)-তার শ্রদ্ধেয় ভাই হজরত হাকাম বিন আবি আল-আস (রা.)-কে একটি সেনাবাহিনীর সেনাপতি বানিয়ে ভারতের ‘থানা’ ও ‘ভারুচ’ বন্দরে পাঠান। অন্যদিকে তিনি তার দ্বিতীয় ভাই হজরত মুগিরা বিন আবি আল-আস সাকফি (রা.)-কে একটি সৈন্যবাহিনী নিয়ে পাকিস্তানের ‘দেবল’ বন্দরে পাঠান। তবে এগুলো ছিল অস্থায়ী খন্ডযুদ্ধ, কোনো স্থায়ী সামরিক যুদ্ধ ছিল না। এ কারণেই সাধারণত ইতিহাসের বইয়ে এ সম্পর্কে কোনো কথা উল্লেখ নেই। একইভাবে বেলুচিস্তান, সিন্ধুসহ আরও কিছু এলাকায় সাহাবিদের পবিত্র জামাতের আগমন ঘটেছে যা ‘ওয়ারুদে মাসউদ’ গ্রন্থের বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত। ব্যবসা-বাণিজ্য ও দ্বীন প্রচারের লক্ষ্যে সাহাবায়ে কেরাম বিভিন্ন অঞ্চল ও দেশে ছড়িয়ে পড়েন। তাদের আবাসস্থল শুধু মক্কা-মদিনা বা আরবের কিছু অঞ্চলই ছিল না। ইতিহাসগ্রন্থে পঁচিশজন সাহাবির নাম জানা যায় যাদের শুভাগমন উপমহাদেশে যুদ্ধের জন্য হয়েছিল। অন্যথায় ধারণা করা যায় যে অনেক সাহাবি নিশ্চয়ই উপমহাদেশে সফর করেছেন এবং তারা এই অঞ্চলের বিভিন্ন স্থান নিজেদের আশ্রয়স্থল বানিয়েছেন। তার যুগে ১১ জন সাহাবির নাম পাওয়া যায় যারা ভারত অঞ্চলে এসেছিলেন।
উল্লেখযোগ্য কিছু অবদান
হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-তাঁর খিলাফতের সময় উল্লেখযোগ্য কিছু অবদান রাখেন। সেগুলোর মধ্যে আছে হিজরি সন প্রবর্তন, তারাবিহর নামাজ জামাতে পডার ব্যবস্থা, নাগরিকদের তালিকা প্রণয়ন, বিচারের জন্য কাজি নিয়োগ, ডাকব্যবস্থা প্রবর্তন ইত্যাতি। তিনি বহু রাজ্য জয় করে সামাজ্য বিস্তার করেন, নগর পত্তন করেন, এবং রাষ্ট্রকে বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত করেন। হজরত উমর (রা.)-প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ক্রমে সাহাবিদের বেতন নির্ধারণ করেন। জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা ও প্রসারের ক্ষেত্রে হজরত উমর (রা.)-এর অবদান প্রচুর। তিনি আরবি কবিতা পাঠ এবং তা সংরক্ষণের ওপর গুরুত্ব দেন। আরবি ভাষার শুদ্ধতা রক্ষার ব্যাপারে তিনি খুব সচেতন ছিলেন। মদিনায় হিজরতের পর সব যুদ্ধ, চুক্তি, বিধিবিধান প্রবর্তন ইসলাম প্রচারের বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন সব ঘটনায় রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে হজরত উমর (রা.)-সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
খাইবারের বিজিত ভূমি মুজাহিদদের মধ্যে বণ্টনের সময় হজরত উমর (রা.)-তাঁর ভাগটুকু আল্লাহর রাস্তায় ওয়াকফ করে দেন। তাবুক অভিযানের সময় রাসুল (সা.)-এর আবেদনে সাডা দিয়ে তিনি তাঁর অর্ধেক সম্পদ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাতে তুলে দেন। হজরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে রাজ্য বিজয় হয় বেশি। তিনি পারস্য, ইরাক, রোমান, মিশর, সিরিয়া প্রভূতি রাজ্য বিজয় করেন। তিনি খালিদ-বিন-ওয়ালিদ, আমার-বিন-আল-আস এবং সাদ বিন আবু ওয়াককাস প্রভূতি বীরদের সহযোগিতা পান। ঐতিহাসিক পিকে হিট্টি বলেন-রাসুল (স.)-এর মৃত্যুর পর যে যাদুমন্ত্রের ছোয়ায় অনুর্বর আরবদেশ অসংখ্যা ও অতুলনীয় যোদ্ধা উৎপাদনের ক্ষেত্রে রূপান্তরিত হলো। এসব বীর যোদ্ধাদের সাহায্যে তিনি সমগ্র পারস্য ও রোমান সামরাজ্য দখল করে বিশ্বের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সংযোজন করেন। খলিফা আবু বকরের সময় হযরত ওমর খলিফা নির্বাচিত হতে অস্বীকৃতি জানান।
হজরত আবু বকর (রা.)-এ ব্যাপারে বলেন— ওমর তুমি খিলাফত না চাইতে পার কিন্তু খিলাফত তোমাকে চায়। তিনি খলিফা নিযুক্ত হওয়ার পর জনসাধারন তাকে আমিরুল মুমেনিন অর্থাৎ বিশ্বাসী মুসলমানদের নেতা উপাধীতে ভূষিত করে। কাজী নজরুল ইসলাম তার উমর ফারুক কবিতায় কি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন-তিমির রাত্রি–এশার আজান শুনি দূর মসজিদে প্রিয়-হারা কার কান্নার মত-এ বুক আসিয়া বিধে আমির-ঊল-মুমেনিন তোমার স্মৃতি যে আজানের ধ্বনি-জানে না মুয়াজ্জিন! পহেলা মহররম তিনি শাহাদতপ্রাপ্ত হন। তিনি দুনিয়ায় সুসংবাদপ্রাপ্ত ১০ সাহাবির অন্যতম একজন। মদিনায় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর রওজার পাশেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট