চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দিনে কিংবা রাতে যে কোনো সময় গেলেই ব্যাথায় কাতর মানুষের রক্তমাখা পোশাক আর গোঙানির শব্দ শোনা যায়। সেখানকার জরুরি বিভাগের চিত্র সরাসরি দেখতে গিয়ে এক রোগীর পিছুর নেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনের প্রতিবেদক।
দেখা যায়, গুরুতর আহত সেই রোগীকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে হুইল চেয়ার এনে জরুরি বিভাগের দায়িত্বরত মেডিকেল অফিসারের কক্ষের সামনে রাখা হল। এরপর দীর্ঘ অপেক্ষা— কখন আসবে ডাক্তারের ডাক? সেই অপেক্ষা শেষে সংকেত যখন মিলল, রোগী তখন অচেতন। জরুরি বিভাগের ব্রাদার এসে রোগীকে গজ-ব্যান্ডেজ লাগিয়ে ২৬ কিংবা ২৮ নং ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে গিয়ে ওয়ার্ডে ঢোকার পর ইন্টার্নি ডাক্তার এসে আহত সেই ব্যক্তিকে দেখতে আসেন আরও আধঘন্টা পর।
জানা যায়, আহত এই ব্যক্তিকে দুপুর দেড়টায় ইন্টার্নি ডাক্তার সেবা দেওয়া শুরু করলেও তার দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল সকাল সাতটায়। স্থানীয় হাসপাতাল থেকে চমেক হাসপাতালে পাঠানো হলে দীর্ঘযাত্রা পথে হাসপাতালে আসা ও চিকিৎসা শুরু করার সময় লেগেছে প্রায় ৬ থেকে ৭ ঘন্টা। দীর্ঘ এ সময়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে আহত ওই ব্যক্তির। পরদিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চিকিৎসাধীন অবস্থায় সেই লোকটি মারা গেছেন।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৬ ও ২৮ নং ওয়ার্ডে এমন অনেক ব্যক্তির খোঁজ মিলেছে— যাদের দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে পারলে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হতো না। অনেককে বিদায় নিতে হতো না পৃথিবী থেকে।
২৮ নং ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন সদরুলের স্ত্রী আয়েশা বেগম জানান, কক্সবাজারে ব্যবসার কাজে প্রায়ই তার স্বামী যাতায়াত করতেন। বাড়ি আসার পথে চন্দনাইশে সৌদিয়া বাসকে ধাক্কা দেয় একটি ট্রাক। বাসের জানালার পাশে বসা ছিলেন তার স্বামী। দুর্ঘটনায় তার স্বামী মাথায় ও পায়ে আঘাত পান। দুই মাস ধরে স্বামীকে নিয়ে তিনি এখন ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন।
আযেশা বেগমের চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। সেদিনের কথা মনে করতে গিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেন তিনি। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন তার স্বামী রাস্তায় পড়ে আছেন। রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলে সেখান থেকে তার স্বামীকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
আয়েশা বেগম বলেন, ওর অবস্থা চোখে দেখার মত ছিল না। পা ফেটে গিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। মহাসড়কে সিএনজি নেই। কোনরকমে একটা ব্যবস্থা করে তার স্বামীকে শহরে আনা হয়। আসরের পরে অ্যাকসিডেন্ট হলেও রাত রাত সাড়ে দশটায় প্রথম চিকিৎসা পেয়েছে তার স্বামী। দেখা গেছে, প্রথমে দুর্ঘটনাস্থল, এরপর স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং সবশেষ সড়কপথে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাত্রা। এতে সবমিলিয়ে এই এক দুর্ঘটনাতেই চিকিৎসাসেবা শুরু করতে ৯ থেকে ১০ ঘন্টা লেগে গেছে।
চমেক হাসপাতালে আসা আয়েশা বেগম কিংবা আবদুর রহমানের মতো কেউ কেউ তাদের স্বজনদের জীবিত দেখার সৌভাগ্য অর্জন করলেও অনেকেরই কপাল দুর্ভাগা।
শনিবার (২৬ ডিসেম্বর) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মর্গের পাশে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে দেখা গেল স্বপ্না বেগমকে। সীতাকুণ্ডে সড়ক দুর্ঘটনায় তার বাবা আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। আর এই ঘটনায় তার চিকিৎসা শুরু হতে হতেই সময় লেগেছে অন্তত ৬ থেকে ৭ ঘন্টা। ফলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান স্বপ্নার বাবা।
দুর্ঘটনাজনিত সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ আবদুল হাই চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, জরুরি সেবা বলতে এদেশে প্রাথমিক চিকিৎসাকে বোঝানো হয়। কিন্তু জরুরি সেবা দিতে হলে প্রশিক্ষিত লোকবল ও লজিস্টিক সাপোর্ট দরকার। কিন্তু সেটা সেভাবে মেলে না। এ কারণে সড়ক দুর্ঘটনার পর শুধুমাত্র জরুরি চিকিৎসাসেবা না মেলায় আহত অনেক ব্যক্তিকে হারাতে হচ্ছে শরীরের মূল্যবান অঙ্গপ্রত্যঙ্গ।
সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ বা সিআইপিআরবির নির্বাহী পরিচালক ডা. একেএম ফজলুর রহমান বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার পর চিকিৎসা পেতে অনেক সময় লেগে যায়।
তিনি বলেন, জরুরি মেডিকেল সার্ভিস বলতে আমরা যা বলি, উন্নত বিশ্ব যেটা ঘটে— যদি একটা দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে প্রথমেই একটা কল সেন্টারে ইনফর্ম করা হয়। এরপর প্রশিক্ষিত জনবল পাঠিয়ে আহত ব্যক্তিটিকে উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে ব্যবস্থা করে। হাসপাতালে যাওয়ার পথে যতটুকু চিকিৎসা দেওয়া দরকার তা দিয়ে হাসপাতালে সঠিকভাবে ট্রান্সফার করা হয়। হাসপাতালে জরুরি বিভাগে লোক রেডি থাকে। তারা সেখানেই জরুরি কক্ষে চিকিৎসা দেওয়ার পরই যদি দরকার হয়, তাহলে ইনডোরে ভর্তি করা হয়।
তিনি আরও বলেন, আমাদের এখানে সমন্বিতভাবে এই তিনটা বিষয় গড়ে ওঠেনি। তার কাছ থেকে জানা গেল, উন্নত বিশ্বে প্যারামেডিক বলে আলাদা ইউনিট থাকে। কোনো দুর্ঘটনায় প্রাথমিক জরুরি চিকিৎসা দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষিত এই বিশেষ কর্মীরা। তেমন একটি ইউনিট তৈরি খুবই জরুরি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সবশেষ বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে ২৪ হাজারের বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে।
জানা যায়, চট্টগ্রামে বেশিরভাগ ক্লিনিক ও হাসপাতালে জরুরি বিভাগ নেই। কিছু ক্লিনিক বা হাসপাতালে ইমারজেন্সি বলে সাইনবোর্ড টাঙানো থাকলেও সেখানে গুরুতর ঘটনার জরুরি চিকিৎসা মেলে না। বড়জোর কাঁটাছেড়ার ব্যান্ডেজ মেলে। অথচ ২০১৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি গুরুতর আহত ব্যক্তিদের জরুরি চিকিৎসাসেবা দিতে দেশের সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালকে নির্দেশ দিয়ে রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে জরুরি চিকিৎসাসেবা প্রদান এবং চিকিৎসা না পেলে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি কোথায় অভিযোগ করবে সে বিষয়ে নীতিমালা করতেও সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রামে বেশিরভাগ প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতালে জরুরি বিভাগ চালু করার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করছেন খোদ মালিকরাই। এক্ষেত্রে তাদের অনেকেই মনে করেন, জরুরি বিভাগে রোগী ভর্তি করালে মামলার মতো অহেতুক ঝামেলায় জড়ানো হতে পারে। অথচ ২০১৬ সালে দেওয়া হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসা দিতে বাধ্য যেকোনো হাসপাতাল। আইনি জটিলতার আশংকায় চিকিৎসা সেবা দিতে অস্বীকার করা যাবে না বলেও নির্দেশনা দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।
সিপি