সড়কে এবার বাইক ছুটবে দুরন্ত গতিতে, উঠতে যাচ্ছে সিসির বিধিনিষেধ

৩৫০ সিসি পর্যন্ত অনুমতি মিলতে পারে

মোটরসাইকেলের স্থানীয় বাজারের দীর্ঘদিনের চাওয়া পূরণে এবার সাড়া দিতে চলেছে সরকার। এর ফলে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মোটরসাইকেলের ওপর দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার জোর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

নতুন প্রস্তাবনা অনুযায়ী, ১৬৫ সিসি থেকে ৩৫০ সিসি পর্যন্ত মোটরসাইকেলের অনুমতি দেওয়ার জন্য দুই চাকার ইঞ্জিনের ওপর যে বিধিনিষেধ রয়েছে, সেটি তোলার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে ইতিমধ্যে।

উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মোটরসাইকেল সরকারের সম্মতি পেলে বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশকে বিনিয়োগের গন্তব্য হিসেবে বিবেচনা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য শাখার (আইআইটি) শাখার অতিরিক্ত সচিব এএইচএম শফিকুজ্জামান নিশ্চিত করেছেন, ইতিমধ্যে এই বিষয়ক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মোটরসাইকেল ও দুই চাকার ইঞ্জিন স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের অনুমতি দেওয়ার জন্য নীতি সংশোধনেরও পরিকল্পনা করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ইতোমধ্যে মোটরসাইকেল শিল্পে প্রায় আট হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ দেখেছে। চার বছর আগে সরকার মোটরবাইকের স্থানীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য পলিসি বেনিফিট চালু করার পর থেকে বাইকের দাম প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে গেছে।

বছরে এখন ৫ লাখেরও বেশি মোটরবাইক বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশে। ২০১৬ সালে বিক্রির এই পরিমাণ ছিল দুই লাখেরও কম।

‘অদ্ভুত’ এক নিষেধাজ্ঞা

২০-এর দশকের শুরু পর্যন্ত বাংলাদেশে মোটরবাইকের ওপর ইঞ্জিন ধারণক্ষমতা নিয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। কিন্তু এরপর সরকার হঠাৎ করেই মোটরসাইকেলের ইঞ্জিনের ধারণক্ষমতার সীমা নির্ধারণ করে দেয় ১৫০ সিসি পর্যন্ত। তখন এ নিয়ে যুক্তি দেখানো হয় যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপরাধীদের ধাওয়া করে তাদের শক্তিশালী দ্রুত মোটরসাইকেলের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। যদিও এরকম কোনো উদাহরণ দেখাও যায়নি।

‘অদ্ভুত’ এই যুক্তি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বেঙ্গলস মোটরসাইকেল ক্লাবের প্রেসিডেন্ট সালেক শাহরিয়ার বলেন, ‘অন্যান্য দেশ নিরাপত্তার স্বার্থে কম ক্ষমতাসম্পন্ন দুই চাকার গাড়ি মহাসড়ক থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ করেছে ঠিক উল্টোটা। যারা মোটরসাইকেল চালায় তারা ভাল করেই জানে যে আধুনিক, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ইঞ্জিন শুধু গতির জন্যই নয়, যানবাহনের ওপর আরো ভালো নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করার জন্যও জরুরি।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন এক্সপ্রেসওয়ে রয়েছে এবং ন্যূনতম গতিতে সেখানে চলাচল করা কম ক্ষমতাসম্পন্ন মোটরসাইকেলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণও।’

একটি মোটরসাইকেল কোম্পানির সাবেক এই বিপণন প্রধান বললেন, ‘সড়ক অবকাঠামো বা অর্থনৈতিক দিক থেকে আমাদের পিছনে থাকা যে কোনো আঞ্চলিক দেশে যান, আপনি দেখতে পাবেন মানুষ সেখানে তাদের প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন ক্ষমতাসম্পন্ন মোটরসাইকেল চালাচ্ছে এবং কিনতে পারছে।’

উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘শ্রীলংকানরা ২৫০ সিসি মোটরসাইকেল চালাচ্ছে। ভারত, পাকিস্তান এবং নেপালেও ইঞ্জিনের ক্ষমতার তেমন কোনো সীমা নির্দিষ্ট করা নেই। এসব দেশে দুর্ঘটনার হার আমাদের চেয়ে অনেক কম। আসলে আরোহীদের শিক্ষা এবং দায়িত্ববোধই সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।’

যে অদ্ভুত যুক্তিতে মোটরসাইকেলের ওপর বিধিনিষেধ লাগানো হয়েছিল সে বিষয়ে ইফাদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাসকিন বলেন, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বাইক ছিল। তারা চাইলে বর্তমান শক্তিশালী অর্থনীতির সাথে আরও শক্তিশালী সাইকেল অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।

স্থানীয় বাইক নির্মাতাদের জন্য ব্যয়বহুল নিষেধাজ্ঞা

মোটরসাইকেল উৎপাদনের অগ্রদূত রানার অটোমোবাইলস লিমিটেড প্রায় তিন বছর আগে নেপালে মোটরসাইকেল রপ্তানি শুরু করে এবং এখন অন্যান্য দেশেও রপ্তানির বাজার খুঁজছে। তবে যেহেতু ইঞ্জিনের ক্ষমতার একটি বিধিনিষেধ রয়েছে, তাই কোম্পানিটি বাংলাদেশে রপ্তানিযোগ্য ২০০ সিসি মোটরসাইকেলের পরীক্ষা চালাতে পারে না।

রানার চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান খান বলেন, মোটরবাইক বিদেশে রপ্তানি শেষে সেখানকার রাস্তায় চলার পরই আমরা বুঝতে পারি, বাইকে কী কী সমস্যা রয়েছে। কিন্তু এটি তো যৌক্তিক কোনো উপায় হতে পারে না। বিদেশের বাজার ধরতে আগ্রহী একটি প্রতিষ্ঠান তো এভাবে নিজেদের পণ্যের মানোন্নয়ন করতে পারে না।

বাংলাদেশ মোটরসাইকেল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হাফিজুর রহমান বলেন, তার এসোসিয়েশন সরকারকে অনুরোধ করেছে ইঞ্জিন ধারণক্ষমতার সীমা পুনর্বিবেচনা করতে। নইলে এই শিল্পের সম্ভাবনা অচিরেই হারিয়ে যাবে।

যেসব দেশ সফলভাবে দুই চাকার যানের ‘উৎপাদন কেন্দ্র’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, তা সে ভারত, থাইল্যান্ড বা ইন্দোনেশিয়া যাই হোক না কেন, তারা বিনিয়োগকারীদের একই সঙ্গে দুটি জিনিস প্রস্তাব করে থাকে। এর একটি হল আকর্ষণীয় স্থানীয় বাজার এবং রপ্তানিবান্ধব পরিবেশ।

রানার কয়েক বছর ধরে আমেরিকান ব্র্যান্ড ইউনাইটেড মোটরসের সঙ্গে কাজ করছে। কিন্তু কোম্পানিটি শুধুমাত্র কম ক্ষমতাসম্পন্ন ইঞ্জিন উৎপাদন ও রপ্তানি করার অনুমতিই পেয়েছে। ইউনাইটেড মোটরস রানারকে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মোটরসাইকেল বানাতে দিতে সম্মত হয়নি, কারণ তারা স্থানীয় বাজারে প্রবেশাধিকার ছাড়া বিদেশের বাজারে তাদের পণ্যের সাফল্য নিয়ে সন্দিহান ছিল।

বাংলাদেশে সুজুকি মোটরসাইকেলের প্রস্তুতকারক র‌্যানকন মোটরবাইক লিমিটেড নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে চিঠি লিখেছে। সেটা যদি পুরোপুরি না হয়, তাহলে তারা এই অনুরোধও জানিয়েছে যেন অন্তত সিসি লিমিট বাড়ানো হয়, যাতে কোম্পানিটি রপ্তানির জন্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সুজুকি বাইক উৎপাদনে আরও বিনিয়োগ করতে পারে।

জাপানের কাওয়াসাকি হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ ২০১৯ সালের শেষের দিকে সরকারকে চিঠি লিখে জানায় যে তারা তাদের বিশ্ববিখ্যাত মোটরসাইকেল উৎপাদনে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চায়। কিন্তু ইঞ্জিন ধারণক্ষমতার সীমা থাকায় কোম্পানিটি শঙ্কিত ছিল যে তাদের বিনিয়োগ শেষ পর্যন্ত সুফল দেবে না।

একই বার্তা দিয়েছে কাওয়াসাকির বাংলাদেশি ডিস্ট্রিবিউটর এশিয়ান মোটরবাইক লিমিটেডও।

এশিয়ান মোটরবাইক লিমিটেডের অপারেশন প্রধান সাফাত ইশতিয়াক বলেন, এই নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশি মোটরসাইকেল শিল্পকে উন্নত প্রযুক্তি থেকে বঞ্চিত করছে।

সম্প্রতি ভারতের বিখ্যাত মোটরসাইকেল নির্মাতা রয়্যাল এনফিল্ড বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য স্থানীয় অটোমোবাইল গ্রুপ ইফাদের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।

ইফাদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাসকিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করছি যে, সুযোগগুলো আমরা হারিয়ে ফেলছি। বিশ্বের সেরা কোম্পানি যেমন বিএমডব্লিউ এবং ডুকাটি বাংলাদেশের বাজার নিয়ে গবেষণা করছে। আমরা যদি তাদের স্বাগত জানাতে পারি তাহলে তারা প্রত্যেকেই বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে।’

জাপানি হোন্ডা, ইয়ামাহা, ইন্ডিয়ান হিরো, বাজাজ এবং টিভিএস ইতিমধ্যে বাংলাদেশে মোটরসাইকেল তৈরির কারখানা নির্মাণ করেছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এএইচএম শফিকুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশ এই নিষেধাজ্ঞা বজায় রাখতে পারবে না। কারণ বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় ঢুকতে যাচ্ছে। আমরা যদি অন্য বাজারে প্রবেশাধিকার চাই, তাহলে আমাদেরও বাণিজ্যের অনুমতি দিতে হবে। এছাড়াও শিল্পে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে আমাদের।’

সবাই পক্ষে নয়

ভারতীয় মোটরসাইকেল জায়ান্ট হিরো মটোকর্প ও বাংলাদেশের নিটল-নিলয় গ্রুপের যৌথ উদ্যোগ এইচএমসিএল নিলয় বাংলাদেশের চেয়ারম্যান আব্দুল মাতলুব আহমেদ মনে করেন, বাংলাদেশের উচিত জনগণের ক্রয় ক্ষমতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে উচ্চ-সিসি মোটরসাইকেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা বজায় রাখা।

তিনি মনে করেন, অনভিজ্ঞ আরোহী এবং খারাপ রাস্তার কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেশি হবে।

বাংলাদেশ মোটরসাইকেল অ্যাসেম্বলিয়ার্স অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনও ধারণক্ষমতার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ধারণার বিরোধিতা করছে। জাপানি হোন্ডা এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগ বাংলাদেশ হোন্ডা (প্রাইভেট) লিমিটেডও সিসি-লিমিট শিথিল করার বিরুদ্ধে। তাদের মতে, বাংলাদেশকে আগে স্থানীয় বাজারের উন্নয়ন করতে হবে।

বাংলাদেশ হোন্ডা (প্রাইভেট) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার হিহিকো কাতসুকি সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ইঞ্জিনের বাইকের অনুমোদন বর্তমান বাইকের বাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। সরকারের বর্তমান নীতি মেনে যারা এই শিল্পে বিনিয়োগ করেছে, তারা চাপের মুখে পড়বে।

সিপি

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড অবলম্বনে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!