চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফজলুল কাদের চৌধুরীর নামে হল নির্মাণ হচ্ছে না। এমন একটি প্রস্তাব এলেও সেটি সিন্ডিকেট বাতিল করে দিয়েছে জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা কোনো বিতর্কে জড়াতে চায় না। ফজলুল কাদের চৌধুরী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে সরাসরি স্বাধীন বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নেন এবং তার বিরুদ্ধে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।
এর আগে জানা যায়, পুরোনো শামসুন নাহার হলের জায়গায় ছাত্রদের জন্য নতুন যে আবাসিক হল নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে, গত ২২ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ৫৫৯তম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সট্রাঅর্ডিনারি সিন্ডিকেট সভায় নেওয়া এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ওই হলের নাম ঠিক করা হয়েছে ‘ফজলুল কাদের চৌধুরী’ হল। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ফাঁসি হওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে স্বাধীন বাংলাদেশের সরাসরি বিপক্ষে এবং ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রায় দেড় মণ সোনা নিয়ে নৌযানে করে দেশ থেকে পালানোর সময় চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার গহিরা উপকূলে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়েছিলেন তিনি। চট্টগ্রামে শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনী, আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠনে তিনি অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেন। পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক থাকা অবস্থায় ১৯৭৩ সালে ১৮ জুলাই হার্ট অ্যাটাকে তার মৃত্যু হয়।
সিন্ডিকেটেই বাতিল বিতর্কিত প্রস্তাব
রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সিন্ডিকেটের মিটিংয়ে হলের নাম পরিবর্তনের জন্য গঠিত কমিটির রিপোর্টটি মোটা দাগে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। সেখানে মূলত শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের ছয়টি স্থাপনার নাম বদলের প্রস্তাব ছিল। কমিটির কাছ থেকে প্রস্তাব এসেছিল পুরোনো শামসুন নাহার হলের জায়গায় ছাত্রদের নতুন একটি আবাসিক হলটি ফজলুল কাদের চৌধুরীর নামে করার। এটা মোটা দাগে করা হয়েছিল। কিন্তু সিন্ডিকেট মিটিংয়ে তৎক্ষণাৎ সেই প্রস্তাব বাতিল করে দেওয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল ফ্যাসিবাদ সংশ্লিষ্ট ও শেখ হাসিনা পরিবারের নামে হওয়া স্থাপনাগুলোর নাম বদলানো।’
তাহলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবু ইউসুফ আলমের নামে হওয়া দ্বিতীয় কলা অনুষদ ভবনের নাম কেন বদলানো হল? তিনিও কি ফ্যাসিবাদি ছিলেন— এমন প্রশ্নের উত্তরে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার বলেন, ‘এটি নিয়ে আমাদের অনেকেই গররাজি ছিলেন। জুলাই আন্দোলনে শহীদদের নামে স্থাপনার নামকরণের দাবি ছিল ছাত্রদের পক্ষ থেকে। নানা দিক বিবেচনা করে শহীদ হৃদয় চন্দ্র তরুয়ার নামে নামকরণের সিদ্ধান্ত নেয় সিণ্ডিকেট। চবির শহীদ দুই ছাত্রই ওই ফ্যাকাল্টির ছাত্র। তবে এটা ঠিক যে, আবু ইউসুফ আলমের নামে নামকরণটাও ওই সময় সিণ্ডিকেটের মাধ্যমে হয়নি।’
ফজলুল কাদের চৌধুরীর নাম সিন্ডিকেট সভায় কেন বাতিল করা হল— এমন প্রশ্নের উত্তরে ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছিলেন— সেটা যেমন সত্য। তেমনি আবার মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায়ও তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখন কোনো বিতর্কে জড়াতে চায় না। পরিচ্ছন্ন ইমেজ নিয়ে সুষ্ঠুভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করাই কর্তৃপক্ষের মূল লক্ষ্য।’
ছাত্রসংগঠনের প্রতিবাদ
স্বাধীনতাবিরোধী ফজলুল কাদের চৌধুরীর নামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মিতব্য আবাসিক হলের নামকরণের সিদ্ধান্তের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে বিভিন্ন সংগঠন। মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত এই ব্যক্তির নাম বাতিল করে হলটি প্রখ্যাত বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামের নামে নামকরণের দাবি জানিয়েছে তারা।
বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) চট্টগ্রাম নগরীর এক ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ছাত্র ইউনিয়ন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতারা বলেন, ‘যে মানুষটা কখনও চায়নি বাংলাদেশ নামে একটা রাষ্ট্রের জন্ম হোক, যিনি সরাসরি মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল তার নামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মিতব্য আবাসিক হলের নামকরণের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অবিলম্বে স্বাধীনতাবিরোধী ফজলুল কাদের চৌধুরীর নাম বাতিল করতে হবে। এই হলের নাম বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম ঘোষণা করতে হবে।’
সংবাদ সম্মেলনে ছাত্র ইউনিয়ন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক ইফাজ উদ্দিন আহমদ লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনী গণহত্যা শুরু করার পর মুসলিম লীগের শীর্ষনেতা মালিক মোহাম্মদ কাসিমকে সঙ্গে নিয়ে ফজলুল কাদের চৌধুরী গভর্নর টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে কিভাবে পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনীকে সহযোগিতা করা যায় এবং তৎকালীন পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার সংগ্রাম ধূলিসাৎ করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করেন।’
এতে বলা হয়, ‘ফজলুল কাদের চৌধুরীর গুডস হিলের বাড়িটি চট্টগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্যাতনের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর নৌযানে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় আনোয়ারা উপজেলায় গহিরা উপকূলে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে তিনি। পরে তাকে বাঙালির বিরুদ্ধে ভয়াবহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠনের অভিযোগে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি করা হয়।’
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সভাপতি সুদীপ্ত চাকমা, সাধারণ সম্পাদক ইফাজ উদ্দিন আহমদ, সাংগঠনিক সম্পাদক নয়ন কৃষ্ণ সাহা, শিক্ষা ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক সোহেল রানা এবং চট্টগ্রাম জেলা সংসদের সাধারণ সম্পাদক শুভ দেবনাথ প্রমুখ।
যে ছয় স্থাপনা পেয়েছে নতুন নাম
গত শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে ৫৫৯তম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সট্রাঅর্ডিনারি সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ছাত্রদের নবনির্মিত আবাসিক হল ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে’র নাম বদলে রাখা হয়েছে ‘শহিদ মো. ফরহাদ হোসেন হল।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এই শিক্ষার্থী গত বছরের ৪ আগস্ট মাগুরা শহরের পারনান্দুয়ালী এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
‘জননেত্রী শেখ হাসিনা হলে’র নতুন নাম দেওয়া হয়েছে ‘বিজয় চব্বিশ’ হল। অন্যদিকে ছাত্রীদের আবাসিক হল ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে’র নাম বদলে রাখা হয়েছে ‘নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী’ হল। ফয়জুন্নেসা ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ও একমাত্র মহিলা নওয়াব ও নারীশিক্ষার পথিকৃৎ।
দ্বিতীয় কলা অনুষদ ভবন ‘আবু ইউসুফ ভবনে’র নতুন নাম দেওয়া হয়েছে ‘শহীদ হৃদয় চন্দ্র তরুয়া ভবন’। আবু ইউসুফ বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক উপাচার্য ছিলেন। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হৃদয় চন্দ্র তরুয়া গত বছরের ১৮ জুলাই চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও এলাকায় ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ মিছিল চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হওয়ার পাঁচদিন পর হাসপাতালে মারা যান।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বঙ্গবন্ধু উদ্যানে’র নতুন নাম দেওয়া হয়েছে ‘জুলাই বিপ্লব উদ্যান’। অন্যদিকে ‘শেখ কামাল জিমনেসিয়ামে’র নতুন নাম ঠিক করা হয়েছে ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জিমনেসিয়াম’।
সিপি