স্বপ্ন দেখিয়ে ২১৩ কোটি খরচের পর চট্টগ্রাম-ঢাকার দুই বিলাসী প্রকল্প বাতিলের খাতায়

সম্ভাব্যতা যাচাইয়েই পুরো টাকা গচ্ছা

চট্টগ্রাম-ঢাকা এক্সপ্রেসওয়ে ও চট্টগ্রাম-ঢাকা হাইস্পিড ট্রেন লাইন সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের নামেই খরচ করা হয়েছে ২১৩ কোটি টাকারও বেশি। দুটি প্রকল্পই এখন বাতিল কিংবা বাতিল হওয়ার পথে। বিলাসী এই দুটি প্রকল্পই সেভাবে গুরুত্বপূর্ণ বা জরুরি না হলেও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের নামে বিপুল এই সরকারি অর্থ অপচয় করা হল।

সরকারি নির্দেশনা অনুসারে, ৫০ কোটি টাকা বা তার বেশি খরচ পড়ে— এমন সব উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের আগে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ফলে বর্তমানে বেশিরভাগ প্রকল্প গ্রহণের আগেই সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। সাধারণভাবে এটি ইতিবাচক হলেও অপ্রয়োজনীয় বা কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের জন্যও সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে অহেতুক। সরকারের বিপুল অর্থ গচ্চা দিয়ে এর কঠিন মূল্য শোধ করতে হচ্ছে।

বিপুল অর্থের কেন এই অপচয়— এমন প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক সময় সুবিধা নিতে বা প্রজেক্ট বিক্রির জন্য পেছনের দরজা দিয়ে কিছু প্রজেক্ট আসে। মন্ত্রণালয়ও এসব প্রজেক্ট মেনে নিতে বাধ্য হয়। কাজ হোক কিংবা না হোক সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশার কাজে শুরুতেই খরচ হয়ে যায় শত কোটি টাকা। এটা বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

১০০ কোটি টাকা গচ্ছা চট্টগ্রাম-ঢাকা এক্সপ্রেসওয়েতে

সম্ভাব্যতা যাচাই ও বিস্তারিত নকশা বাবদ ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ের পর ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোরে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের দশকব্যাপী পরিকল্পনা গত বছরের শেষদিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল করে দিয়েছে সরকার। তবে তার আগেই এজন্য সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশা প্রণয়নে ব্যয় হয়ে গেছে ৯৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। এখন প্রকল্পটি বাদ দেওয়া হলেও সরকারকে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে নেওয়া ১০০ কোটি টাকারও বেশি শোধ করতে হবে। ওই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই গবেষণায় অর্থায়ন করেছিল ব্যাংকটি।

২০০৮ সালে ৪ লেনের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশাপাশি একটি অ্যাক্সেস-কন্ট্রোলড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই এবং নকশার অর্থায়ন করে এডিবি। ২০১৩ সালের মার্চ মাসে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত কমিটি পিপিপির অধীনে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের অনুমোদন দেয়। পরের মাসে সরকার এডিবির সঙ্গে ৯৭ দশমিক ৮৭ কোটি টাকার সম্ভাব্যতা যাচাই এবং বিস্তারিত নকশা সম্পাদনের চুক্তি স্বাক্ষর করে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) এই কাজের জন্য অস্ট্রেলিয়ার এসএমইসি ইন্টারন্যাশনালের নেতৃত্বে একটি জয়েন্ট ভেঞ্চার ফার্মকে নিয়োগ দেয়। প্রতিষ্ঠানটি পরের বছরের আগস্টে গবেষণা প্রতিবেদন জমা দেয়। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে পিপিপির অধীনে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সহায়তা করার জন্য আরেকটি যৌথ উদ্যোগের প্রতিষ্ঠানকে লেনদেন উপদেষ্টা (পরামর্শদাতা) হিসেবে নিয়োগ করা হয়। কিন্তু ২০১৯ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প বাতিল করে ৪ লেনের মহাসড়কের উভয় পাশে সার্ভিস লেন নির্মাণের নির্দেশনা দেন।

১০০ কোটি টাকা খরচ হয়ে যাওয়ার পর কেন প্রকল্পটি বাতিল হলো কেন— গত বছরের অক্টোবরে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. সামসুল আরেফিন বলেন, ‘ওটা একটা ফিজিবিলিটি স্টাডি ছিল। সেজন্য টাকাটা গচ্ছা যায়নি।’

চট্টগ্রাম-ঢাকা বুলেট ট্রেনে ১১৩ কোটি টাকা শেষ

চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় মাত্র এক ঘণ্টায় যাওয়ার জন্য বুলেট ট্রেনের যে ঘোষণা চার বছর আগে রেল কর্তৃপক্ষ দিয়েছিলো সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশা প্রণয়নের পর চলতি বছরের শুরুতে সেই প্রকল্প থেকে সরে এসেছে রেল মন্ত্রণালয়। ৫ বছর আগে, ২০১৭ সালে প্রকল্পটি অনুমোদনের পর প্রায় শত কোটি টাকা ব্যয় করে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর রেল মন্ত্রণালয় এখন মনে করছে, এই মেগা প্রকল্পে হাত দেওয়ার আগে বর্তমান সিঙ্গেল লাইনগুলোকে ডাবল লাইনে রূপান্তরসহ চলমান প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ করতে হবে।

চট্টগ্রাম-ঢাকা বুলেট ট্রেন প্রকল্প সরকারের কাছ থেকে প্রাথমিক অনুমোদন পাওয়ার পর সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশার কাজ করা হয় প্রায় ১১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে। এরপর ২০১৮ সালে চীনা একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে সমঝোতাও হয় যা পরে আবার বাতিলও হয়ে যায়। প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মোট ৩৫০ কিলোমিটার উড়ালপথে পাথরবিহীন ট্র্যাক দিয়ে বুলেট ট্রেন চলার কথা ছিল। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, ফেনী ও চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে মোট পাঁচটি স্টেশন করার কথা যেগুলো আসলে মাল্টি মোডাল ট্রানজিট হাব হিসেবে ব্যবহৃত হবার কথা ছিল।

রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন অবশ্য দাবি করছেন, বুলেট ট্রেন প্রকল্পটি একেবারে বাতিল হয়ে যায়নি। তার ভাষ্য অনুযায়ী, সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশার কাজ শেষ করলেও ওই প্রকল্পে হাত দেওয়ার আগে কিছু স্বল্প ও মধ্যমেয়াদী প্রকল্পের কাজ শেষ করতে হবে।

তবে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের রেল অবকাঠামোর বর্তমান বাস্তবতায় বুলেট ট্রেনের জন্য অর্থ দিতে কোনো সংস্থাই রাজি হচ্ছে না। একটি উন্নয়ন সংস্থা সরাসরি মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে দিয়েছে, এই প্রকল্পের কোনো প্রয়োজন এ মুহূর্তে বাংলাদেশের নেই।

যদিও এর আগে থেকেই গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলে আসছিলেন, প্রকল্পটাই ছিল মূলত চাপিয়ে দেওয়া, যা এসেছিল পেছনের দরজা দিয়ে। তারা প্রশ্ন তোলেন, বাংলাদেশ যেখানে ইলেকট্রিফিকেশনের প্রথম ধাপই এখনও শুরু করতে পারেনি, সেখানে বুলেট ট্রেনের মতো দ্বিতীয় ধাপ কিভাবে শুরু হয়? আর বুলেট ট্রেন করে দিনে ১০-১২টি ট্রিপ না দিতে পারলে এটা কি ব্যয় সংকুলান করতে পারবে? আবার দিনে ১০/১২টি ট্রিপ দেয়ার মতো যাত্রী কি বাংলাদেশে আছে?

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!